ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসার যথাযথ তদন্ত, এবং দোষীদের কঠোর শাস্তিবিধানের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত। আদর্শ পরিস্থিতিতে এই তদন্ত করিবার দায়িত্ব রাজ্য পুলিশের উপর বর্তায়, কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা প্রথমত এবং প্রধানত রাজ্য প্রশাসনের কর্তব্য। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, কারণ কাঠামোগত ভাবে এই রাজ্যে একটি মৌলিক পার্থক্যের কথা গুলাইয়া গিয়াছে। কথাটি হইল, প্রশাসন যদিও রাজনৈতিক শাসকদের অধীনে কাজ করে, কিন্তু তাহার রাজনৈতিক পক্ষপাত থাকিতে পারে না। কে কোন রঙের রাজনীতি করে, কাহার মাথায় কোন নেতার হাত রহিয়াছে, এই বিবেচনাগুলি প্রশাসনের নিকট সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হওয়াই বিধেয়। দুর্ভাগ্য, পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন এই সত্যটি বিস্মৃত হইয়াছে। তাহার দায় অবশ্যই রাজনীতির— শীর্ষ নেতৃত্বের— তাঁহারা প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখিতে পারেন নাই; বস্তুত, সচেতন ভাবে সেই নিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করিয়াছেন। তবে, একই সঙ্গে এই কথাটিও বলা জরুরি যে, এই দোষে শুধু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকরাই দুষ্ট নহেন— ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও একই ঘটনা ঘটে, বহু ক্ষেত্রে ভয়ঙ্করতর রূপে ঘটে; পশ্চিমবঙ্গেও অতীত শাসকরা একই ভঙ্গিতে পুলিশ-প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্য ভারতীয় গণতন্ত্রের— দেশ চালনার ভার যাঁহাদের উপর ন্যস্ত হইয়াছে, তাঁহাদের অধিকাংশই প্রকৃত প্রস্তাবে সেই দায়িত্বের যোগ্য হইয়া উঠিতে পারেন নাই।
দুর্ভাগ্য, পুলিশ-প্রশাসন বা তদন্তকারী সংস্থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিবার এই প্রবণতা সর্বগ্রাসী। কলিকাতা হাই কোর্ট রাজ্যে ভোট-পরবর্তী খুন ও ধর্ষণকাণ্ডগুলির তদন্তের ভার সিবিআই-এর উপর ন্যস্ত করিয়াছে। এই প্রতিষ্ঠানটিও কি নিরপেক্ষ তদন্তের নিশ্চয়তা দিতে পারে? মাদ্রাজ হাই কোর্টের নির্দেশ এই প্রশ্নের নেতিবাচক জবাব দিবে। সম্প্রতি হাই কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ একটি মামলার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের ২০০৩ সালের উক্তির পুনরাবৃত্তি করিয়া সিবিআই-কে ‘খাঁচার তোতা’ বলিয়াছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও সেই কথাই বলে। সিবিআই-এর ন্যায় প্রতিষ্ঠানগুলি ক্রমেই কেন্দ্রীয় শাসকদের হাতের অস্ত্র হইয়া উঠিয়াছে— রাজনৈতিক বিরোধী দমনে ব্যবহৃত হওয়াই যাহার ভবিতব্য। তেমন একটি সংস্থার হাতে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসের তদন্তভার ন্যস্ত হইলে ন্যায়বিচার হইবে, সেই নিশ্চয়তা আছে কি? ভুলিলে চলিবে না যে, এই তদন্তের সহিত কেন্দ্রের শাসক তথা রাজ্যের বিরোধী বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থ প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। দেশবাসীকে এহেন সংশয় পোষণ করিতে হইতেছে, তাহা দুর্ভাগ্যের— কিন্তু, বাস্তব অনস্বীকার্য।
তোতার খাঁচাটি ভাঙিবার যে পথের কথা মাদ্রাজ হাই কোর্ট বলিয়াছে, তাহাই সম্ভবত একমাত্র পথ— সিবিআই-এর ন্যায় সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাহিরে লইয়া আসা, তাহাদের প্রকৃত স্বশাসনের ব্যবস্থা করা। নির্বাচন কমিশনের ন্যায় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানও শেষ অবধি ‘স্বাধীন’ কি না, গত কয়েক বৎসরে সেই প্রশ্ন তুলিবার একাধিক অবকাশ তৈরি হইয়াছে, তাহা সত্য— কিন্তু, স্বশাসনের অধিকার না থাকিলে ততটুকু স্বাধীনতাও ধরাছোঁয়ার বাহিরেই থাকিবে। পুলিশ সংস্কারের যে প্রশ্নটি এত বৎসর ধরিয়া অবহেলিতই থাকিয়াছে, এই প্রসঙ্গে তাহাকেও ফিরাইয়া আনা জরুরি। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাহিরে স্বতন্ত্র সংস্থা গড়িয়া তাহার হাতেই পুলিশ পরিচালনার দায় দেওয়া উচিত কি না, তর্কটি হউক। এই পথটি বিপজ্জনক, সন্দেহ নাই— পুলিশ-প্রশাসনকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বাহিরে রাখিলে তাহার উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণের আর কোনও উপায়ই থাকে না। কিন্তু, রাজনৈতিক শ্রেণি যদি নিজেদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়, তবে নান্যঃ পন্থাঃ।