ফাইল চিত্র।
অতিমারির আবহে গত দু’বছর কার্যত বন্ধ ছিল। এ বছরের রামনবমীতে ফের রাজ্য জুড়ে অস্ত্র মিছিল। তরোয়াল থেকে বন্দুক, বিবিধ অস্ত্রের আস্ফালনের সাক্ষী থাকল গোটা রাজ্যই। মিছিলে অস্ত্র কেন, সেই প্রশ্নের একটি প্রকাশ্য উত্তর আছে, অন্য একটি উত্তর তুলনায় প্রচ্ছন্ন। প্রথম উত্তরটি হল, রামনবমীতে অস্ত্র হাতে মিছিল ধর্মীয় প্রথা। উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের কিছু অংশে কিছু বছর যাবৎ রামনবমী উপলক্ষে অস্ত্র মিছিলের প্রথা প্রচলিত হয়েছে বটে, কিন্তু তা কোনও মতেই বাংলার নিজস্ব প্রথা নয়। অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, এই হিংস্রতার উদ্যাপন বাংলায় ‘বহিরাগত’। নতুন কোনও প্রথাকে বরণ করে নেওয়া যাবে না, এমন দাবি করার প্রশ্ন নেই। কিন্তু, চরিত্রগত ভাবে হিংস্র, অ-সভ্য একটি প্রথাকে কেন বরণ করতে হবে, অস্ত্রপন্থীরা তার কোনও সদুত্তর এখনও দেননি। দেবেন, সেই ভরসাও ক্ষীণ। প্রকৃত প্রস্তাবে, ধর্মীয় প্রথার অজুহাতের আড়ালে লুকিয়ে আছে মূল কারণটি— মুসলমানদের মহরমের মিছিলে যদি অস্ত্র থাকতে পারে, হিন্দুদের রামনবমীতেই বা কেন থাকবে না? এই প্রশ্নের প্রথম উত্তর হল, মহরমে অস্ত্রমিছিল রামনবমীর মিছিলের মতো হঠাৎ কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শুরু হয়নি, সে প্রথা বহু দিনের। কিন্তু, বহু দিন যাবৎ কোনও প্রথা চলছে বলেই তাকে অনন্ত কাল চালিয়ে যেতে হবে, এমন দাবি করা চলে না। মহরমের অস্ত্র মিছিলের প্রথাটি সম্বন্ধেও ভাবার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই প্রথার উদাহরণ দেখিয়ে কোনও মতেই রামনবমীর মিছিলের বৈধতা দাবি করা চলে না।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, শুধু বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলিই নয়, এই বার বিভিন্ন জায়গায় অস্ত্র হাতে মিছিলে হেঁটেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরাও। কেউ বলতেই পারেন যে, হিন্দু ভোটের উপর যাতে নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে, তাই এই কৌশল। বঙ্গে রামনবমীর অস্ত্রের মিছিলের সূচনাই হয়েছিল বাহুবলের প্রদর্শনী হিসাবে। এক অর্থে তাতে অন্যদের সুবিধাই হয়েছে— হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরিসরে প্রবেশের জন্য বাহুবলের সংস্কৃতির চেনা প্রবেশপথটি পাওয়া গিয়েেছ। গোটা রাজ্যই এখন প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনীতে মেতেছে। কাদের হাতে কত অস্ত্র, পশ্চিমবঙ্গের ঘটনাক্রম এখন তাকেই রাজনৈতিক দাপটের প্রকৃষ্টতম মাপকাঠি হিসাবে বেছে নিয়েছে। দল-মত, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ধর্ম নির্বিশেষেও যে রাজনৈতিক সমাজ রামনবমীর মিছিলে মেতেছে, তা মূলত শক্তির প্রদর্শনী। রাজ্য প্রশাসনের পক্ষে এর চেয়ে বড় দুঃসংবাদ আর কী হতে পারে— গোটা রাজ্যে অস্ত্রের ঝঙ্কার শোনা যাচ্ছে, এবং এমন পরিস্থিতি ক্রমে ‘স্বাভাবিক’ হয়ে উঠছে। রাজনীতির সঙ্গে অস্ত্রের সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য নয়, বস্তুত গণতন্ত্রের সঙ্গে সন্ত্রাসের যে প্রকট বিরোধ রয়েছে, বঙ্গবাসী সেই কথাটি ভুলতে বাধ্য হচ্ছেন।
রাজ্যের অস্ত্র সংস্কৃতি এই অস্ত্র মিছিলকে বৈধতা দিল, না কি ধর্মীয় অনুষঙ্গে অস্ত্রের প্রদর্শনীই অস্ত্রের সংস্কৃতিকে বৈধ করে তুলছে— সেই তৈলাধার পাত্রের তর্ক আপাতত বকেয়া থাকুক। প্রশ্ন হল, মিছিল উপলক্ষে যে পরিমাণ অস্ত্র প্রকাশ্যে এসেছে, পুলিশ-প্রশাসন তার উপস্থিতি সহ্য করে কী ভাবে? গত কয়েক সপ্তাহে বেআইনি অস্ত্র নিয়ে বহুবিধ চর্চা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী অস্ত্র উদ্ধারের আদেশ দিয়েছেন, পুলিশও কর্মীদের ছুটি বাতিল করে সেই কাজে নেমেছে। কিন্তু, পুলিশ যতটুকু অস্ত্র উদ্ধার করেছে বা করবে, তা যে হিমশৈলের চূড়ামাত্র, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হিংস্রতার কী বিপুল বন্দোবস্ত এই রাজ্যে হয়ে আছে, রামনবমীর অস্ত্র মিছিল তার আঁচ দেয়। নাগরিকের হাতে এই পরিমাণ বেআইনি অস্ত্র মজুত থাকলে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা যে কার্যত অসম্ভব, তা বলা বাহুল্য। প্রশাসন অবিলম্বে সক্রিয় হোক।