অনেক সময় একটি ছোট ছবি অনেক হতাশা ও তিক্ততার পাহাড় ডিঙাইয়া আশা ও ভালবাসার প্রতি আস্থা ফিরাইয়া আনে। সম্প্রতি ভারতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন বিরাট কোহালি পাকিস্তানের সহিত খেলায় হারিয়াও খেলোয়াড়-সুলভ মনোভাবের যে দৃষ্টান্ত রাখিলেন, তাহা হৃদয়স্পর্শী। পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের নিকট পরাজয়ের পরে তিনি পাকিস্তানি ওপেনার মহম্মদ রিজ়ওয়ানকে আলিঙ্গন করিলেন। রিজ়ওয়ান ও কোহালির সহাস্য মুহূর্তের ছবিটি এত মানবিক বলিয়াই তাহা এত শক্তিশালী। বহু ক্ষুদ্রচিত্ত, মন্দবুদ্ধি রণহুঙ্কারকে ওই সাবলীল হাসি ফুৎকারে উড়াইয়া লইয়া যায়। ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘ সংঘাত এক ঐতিহাসিক সত্য, দশকের পর দশক ধরিয়া দুই দেশের ক্রিকেট ম্যাচকে প্রায় যুদ্ধের সমান করিয়া দেখিবার অভ্যাসটিও দুর্ভাগ্যজনক বাস্তব। দুই দেশের খেলার সময় সমাজের এক অংশ তাহাকে প্রায় সাম্প্রদায়িক ইতিহাসের বোঝাপড়া হিসাবে ভাবিতে থাকেন, বিদ্বেষ-বার্তার ঝড় বহিয়া যায়, ছোট-বড় রাজনৈতিক নেতারা খেলা বন্ধ করিবার হুঙ্কার ছাড়িতে থাকেন। সীমান্তে সন্ত্রাসবাদীদের সহিত যুদ্ধে যাঁহারা শহিদ হইয়াছেন, ক্রিকেট মাঠে দুই দেশ মিলিত হইলে তাঁহাদের স্মৃতিকে অসম্মান করা হইবে, এমন শোরগোল উঠিয়া পড়ে। শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকের মাথা লজ্জায়, গ্লানিতে হেঁট হইয়া যায়। দুই দেশের মধ্যে যতই রাজনীতির বাগাড়ম্বর, কূটনীতির চাল এবং সামরিক বাহিনীর প্রহরা থাকুক, সীমান্তের দুই দিকে যে সাধারণ মানুষের জীবনস্রোত বহিয়া চলিয়াছে, তাহা যে একই সংস্কৃতিতে জারিত, একই আনন্দ-দুঃখে স্পন্দিত, ক্রিকেট, চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও সঙ্গীতের অঙ্গনে যাহারা অনায়াসে আনন্দ ভাগ করিয়া লইতে পারে, শেষ পর্যন্ত কি তবে তাহাদেরই পরাজিত হইবার কথা, কাঁটাতারেরই জিতিবার কথা? অন্তহীন সংঘাতই এই উপমহাদেশ নিজের পথ বলিয়া বাছিয়া লইয়াছে? মৈত্রী, শান্তি, নিরাপত্তা, এই সকলই কি দুর্বলতা বলিয়া নেপথ্যে বিলীন হইয়াছে?
সন্দেহ নাই, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যাহা কিছু রাজনৈতিক, কূটনৈতিক অমীমাংসিত সমস্যা রহিয়াছে, তাহার সমাধানের দায় দুই দেশের সরকারের। কিন্তু এই সকল সমস্যাই ভারত ও পাকিস্তানের মানুষে সম্পর্কের একমাত্র নির্ণায়ক নহে, প্রধান নির্ণায়কও নহে। সাধারণ মানুষ তাহা প্রমাণ করিয়াছেন। এই দেশ ওই দেশের চিত্রতারকা, ক্রিকেট-তারকা, শিল্পী-সাহিত্যিকরা মিলিত হইয়া দেখিয়াছেন যে, দেশের সরকার যাহাই বলুক, নীতি যেমনই হউক, দুই দেশের মানুষ কিন্তু পরস্পরের সহিত সহজ ঘনিষ্ঠতায় আবদ্ধ হন, নিজেদের শত্রু না ভাবিয়া বরং ‘নিকট প্রতিবেশী’ হিসাবে চিনিয়া লন। তাঁহাদের মধ্যে আবশ্যিক কোনও শত্রুতা নাই, আছে কেবল রাষ্ট্রনির্ধারিত সঙ্কটের পারাবার।
বিশেষত ক্রিকেটের ক্ষেত্রে দুই দেশের ক্রীড়াতারকারা সকল বিদ্বেষমূলক প্রচার উপেক্ষা করিয়া পরস্পরের দিকে সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়াইয়াছেন। এক দিকে দুই দেশের শাসক কর্তৃত্বের দাপট দেখাইয়া উভয় দেশের মধ্যে খেলা বন্ধ করিয়াছেন, অন্য দিকে ক্রিকেট ময়দান যে রাজনীতির দ্বারা খণ্ডিত, সীমাবদ্ধ নহে, খেলোয়াড়রা বুঝাইয়া দিয়াছেন। কেবল একটি চিত্রই নহে। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির খেলায় হারিয়াও কোহালি স্বাভাবিক সৌহার্দে আলাপ করিতেছিলেন পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের সহিত, যাহা দেখিয়া সমাজমাধ্যমের একাংশ বিদ্বেষমুখর হইয়াছিল। মহম্মদ আমিরকে কোহালি নিজের ব্যাট উপহার দিয়াছেন, শাহিদ আফ্রিদির জনহিতকর সংস্থার জন্য স্বাক্ষরিত জার্সি উপহার দিয়াছেন। ব্যক্তির সহিত ব্যক্তির সম্পর্ক যে শেষ পর্যন্ত রাজনীতি ও কূটনীতিকে বাহিরে রাখিয়াই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হইতে পারে, মৈত্রী ও শান্তির পক্ষে তাহা বিরাট সুসংবাদ।