প্রতীকী ছবি।
ফের দুই অঙ্কে পৌঁছাইল বেকারত্বের হার। মে মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহান্তে দেশে কর্মসংস্থানের যে ছবিটি দেখা যাইতেছে, তাহা নিম্নরূপ— এক, বেকারত্বের হার প্রায় পনেরো শতাংশের কাছাকাছি; দুই, এই বেকারত্ব বৃদ্ধি লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন বা শ্রমশক্তিতে যোগদানের হার বৃদ্ধির ফলে ঘটে নাই, কারণ সেই হারটি কার্যত অপরিবর্তিত; এবং তিন, গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানহীনতার হার উদ্বেগজনক ভাবে বাড়িতেছে। অসরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা সিএমআইই-র তথ্য হইতে এই ছবিটি উঠিয়া আসিয়াছে। অর্থাৎ, এই পরিস্থিতি সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হইবার একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, পনেরো শতাংশ হারে বেকারত্ব ভারতে স্বাভাবিক ঘটনা নহে। গত বৎসর যখন দেশব্যাপী লকডাউন জারি করা হইয়াছিল, তখন বেকারত্বের হার অস্বাভাবিক বাড়িয়া গিয়াছিল— এবং, অর্থব্যবস্থার চাকা গড়াইতে আরম্ভ করিবার পরই তাহা ফের স্বাভাবিক স্তরে নামিয়া আসে। আবারও দেশের বিভিন্ন রাজ্যে লকডাউন বা ‘কার্যত লকডাউন’ জারি হওয়ায় বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বগামী হইয়াছে। সমস্যাটির চরিত্র তলাইয়া দেখিলে বোঝা সম্ভব যে, যাঁহাদের চাকুরি গিয়াছে, তাঁহাদের চাকুরি যাওয়াই সর্বাপেক্ষা সহজ— অর্থাৎ, তাঁহাদের অধিকাংশই অস্থায়ী বা চুক্তিবদ্ধ কর্মী। বাজারের অভিজ্ঞতা বলিতেছে, তাঁহাদের বেতনও তুলনায় কম। ফলে, চাকুরি গেলে সঞ্চয়ের টাকায় কিছু দিন চালাইয়া লইবার অবকাশও তাঁহাদের কম, ক্ষেত্রবিশেষে একেবারেই নাই। অন্য দিকে, চাকুরির বাজারে নূতন প্রবেশ করিয়া কর্মসংস্থান না করিতে পারা, আর হাতে থাকা চাকুরি খোয়ানো যে চরিত্রগত ভাবে পৃথক, তাহাতেও সংশয় নাই। ফলে, এই বেকারত্বকে তাহার সম্পূর্ণ তাৎপর্যে দেখিতে হইবে।
গ্রামীণ বেকারত্ব বৃদ্ধির সংবাদটিও বিশেষ ভাবে উদ্বেগজনক। গ্রামীণ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানহীনতার হার অন্তত দুইটি কারণে শহরাঞ্চলের তুলনায় কম থাকে— এক, নূতন কর্মসংস্থানে উৎপাদনশীলতা যদি এক আনাও না বাড়ে, তবুও কৃষি বহু শ্রমিককে অন্তর্ভুক্ত করিয়া লইতে পারে, অর্থশাস্ত্রের তর্কে যাহা ‘ডিজ়গাইজ়ড আনএমপ্লয়মেন্ট’-এর সমস্যা বলিয়া পরিচিত। অন্য দিকে, জাতীয় কর্মসংস্থান যোজনাও গ্রামীণ বেকারত্বের হারকে কম রাখিতে সহায়ক। এই বাজেটে একশত দিনের কাজ প্রকল্পে অর্থমন্ত্রী যে কার্পণ্য করিয়াছিলেন, স্পষ্টতই তাহার ফল ফলিতেছে। দুর্ভাগ্য, অভিজ্ঞতা হইতে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা গ্রহণ করে নাই। নচেৎ, লকডাউনের গত দফায় যে প্রকল্প গ্রামীণ অর্থনীতিকে শ্বাসবায়ু জোগাইয়াছিল, তাহার ব্যয়বরাদ্দ ছাঁটিতে সরকার এমন উতলা হইয়া উঠিত না।
অর্থব্যবস্থার চাকা শ্লথ হইলে তাহার প্রত্যক্ষ প্রভাব কর্মসংস্থানের উপর পড়িবে, তাহা স্বতঃসিদ্ধ। এবং, বেকারত্ব বাড়িলে দেশের এক বিপুল সংখ্যক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিবে। এমনকি, চাকুরি হারাইবার আশঙ্কাও মানুষকে হাতের টাকা ধরিয়া রাখিতে প্রবৃত্ত করে। ফলে, বেকারত্ব যেমন এক দিকে মানুষকে বিপন্ন করিতেছে, অন্য দিকে অর্থব্যবস্থায় চাহিদাও কমাইতেছে— ফলে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাটি ক্রমেই সুদূরপরাহত হইতেছে। এই কথাগুলি দেশের কর্তাদের অজ্ঞাত থাকিবার কথা নহে। গত এক বৎসরে বহু বিশেষজ্ঞ বহু ভাবে এই কথা বলিয়াছেন; গণমাধ্যমগুলি আলোচনা করিয়াছে; সমাজমাধ্যমে সাধারণ মানুষ দাবি করিয়াছেন। কিন্তু, বেকারত্ব ঠেকাইবার কোনও ব্যবস্থা— যেমন, বিভিন্ন দেশ একটি নির্দিষ্ট সীমার নিম্নে বেতনপ্রাপ্ত কর্মীদের বেতনের একটি অংশ ভর্তুকিবাবদ দিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে— ভারতে হয় নাই। একশত দিনের কাজ প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়াছে। নিঃশর্ত নগদ হস্তান্তরের ব্যবস্থা হয় নাই। আশঙ্কা হয়, কেন্দ্রীয় সরকার বুঝি দেখিতে চাহে যে বিপর্যয়ের জল কত দূর গড়ায়।