—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কলকাতা থেকে ট্রাম উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, এ খবরটি পেলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়তো বলতেন, “কলকাতার ট্রামের মতো আর হইবে না। হইবার প্রয়োজনও নাই।” কলকাতার ট্রামের মতো আর কিছু যে হবে না, তা সন্দেহাতীত। যানটি সেই সময়ের প্রতীক, কলকাতা যখন বিশ্বজোড়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। কলকাতায় ট্রাম চালু করা ছিল শহরের পথে বিশ্বমানের পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে আসা। ময়দানের মধ্যে দিয়ে যে ট্রামলাইনটি ধর্মতলা থেকে খিদিরপুর যায়— ‘কলকাতার ট্রাম’ বলতে অধিকাংশ সিনেমা ইত্যাদি যে লাইনটিকে চেনে, মূলত তার দৃশ্য-সৌন্দর্যের জন্য— শহরের অন্য লাইনগুলি বন্ধ হলেও সে লাইনটি চালু থাকবে, ঐতিহ্যবাহী প্রমোদ ভ্রমণের জন্য: কলকাতার মেয়র জানিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, কারণ ইতিহাসকে সংরক্ষণ করা, তাকে সাধারণ মানুষের নাগালে রাখা সভ্য সমাজের অগ্রগতির শর্ত। শহরের বিভিন্ন জাদুঘরে, সংগ্রহশালায় তেমনই টুকরো টুকরো অতীত সঞ্চিত আছে। ময়দানের হেরিটেজ ট্রামপথের বাড়তি সুবিধা, সেই অতীতকে আক্ষরিক অর্থেই স্পর্শ করতে পারবেন মানুষ। বিপণনে যথেষ্ট আগ্রহী হলে কলকাতার হেরিটেজ ট্রামলাইন একটি তাৎপর্যপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রেও পরিণত হতে পারে।
কিন্তু, কলকাতার ট্রামের মতো কিছু যে আর ‘হইবার প্রয়োজনও নাই’, সে কথাটিও হয়তো একই রকম সত্য। যে শহরে, যে সময়ে ট্রাম চালু হয়েছিল, সেই শহরও নেই, সেই সময়ও নেই। কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই গত কয়েক বছরে কলকাতার বেশির ভাগ রাস্তায় ট্রাম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাতে শহরের নাগরিকদের যাতায়াতে বিপুল অসুবিধা হয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যায়নি। লক্ষণীয়, ট্রাম পরিবেশবান্ধব, এই যুক্তিটিও যথেষ্ট খাটে না— ট্রামের কারণে রাস্তার অন্য যানবাহন ধীরে চলতে বা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হলে যে বাড়তি দূষণ ঘটে, সেটার হিসাবও কষা প্রয়োজন। অনেকেই বলবেন যে, বিশ্বের বহু শহরেই ট্রাম চলে। সেই শহরগুলির সঙ্গে কলকাতার জনসংখ্যা ও রাজপথের তুলনা করলেই স্পষ্ট হবে যে, কেন কলকাতায় ট্রাম চালানো অসম্ভব। পরিবেশের কথা ভাবলে বরং দ্রুত মেট্রোর কাজ শেষ করার দাবি করা প্রয়োজন। এ শহরে ট্রামগুলির অবস্থা যেমন করুণ, তার পরিকাঠামো তেমন প্রাগৈতিহাসিক। নেহাত আবেগের বশে এই যানটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দাবির কোনও অর্থ নেই। গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালে, শহরের মূল অঞ্চলে ব্যক্তিগত পরিবহণ নিষিদ্ধ করলে বা তাতে বিপুল কর চাপালে, এবং ট্রামের পরিকাঠামোর উন্নতিতে প্রভূত টাকা খরচ করলে ট্রামকে বাঁচিয়ে রাখা হয়তো সম্ভব। কিন্তু তা ভিন্ন সাধনার ফল।
অর্থ না থাকলেও অবশ্য নস্টালজিয়া আছে। নিন্দক বলেন, বাঙালির থিম হল ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। অমুক উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা ট্রামে বসেই প্রেম করতেন, অথবা এক দিন এই ট্রামের এক পয়সা ভাড়া বাড়ায় গোটা শহর উত্তাল হয়ে উঠেছিল, অথবা ট্রাম হল আধুনিক সভ্যতার গতিকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক বিবৃতি— এমন হরেক আবেগের স্রোত বইছে সমাজমাধ্যমে। অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা জরুরি, কিন্তু সেই অতীতেই বাঁচতে চাওয়া বিপজ্জনক। শোনা যায়, ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে লেখা ছিল, ‘যেখানে পরিবর্তন করা জরুরি নয়, সেখানে পরিবর্তন না-করাই জরুরি’। কোনও ছাত্র তার নীচে লিখে রেখেছিলেন, ‘ডাইনোসরের কথা মনে আছে তো?’ ট্রামকাতর নগরবাসী ভাবতে পারেন, যা গেছে তা যাক। কলকাতা নামক মৃতপ্রায় শহরটিকে যদি বাঁচিয়ে তুলতে হয়, তবে অতীত ছেড়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতেই হবে। সেই শুরু করার কাজটি কঠিন বলেই বাঙালি এমন অতীত আঁকড়ে বাঁচতে চায় কি?