এই জুলাইয়ে পাঁচ বছর পূর্ণ হল জিএসটি ব্যবস্থার। কংগ্রেস নেতা, ভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পন চিদম্বরম একটা হিসাব পেশ করেছেন— এই পাঁচ বছরে সরকার গড়ে প্রতি দু’দিনে এক বার জিএসটির নিয়মে ছোট-বড় পরিবর্তন করেছে। বিরোধীপক্ষের হিসাব, তাতে খানিক অতিরঞ্জন থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু, পাঁচ বছরেও যে ব্যবস্থাটি স্থিতিশীল হল না, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। তার একটি বড় কারণ রাজনৈতিক। জিএসটি ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল ভারতের অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার ধর্ম বহুলাংশে বিসর্জন দিয়ে। পরোক্ষ কর আদায়ের যে অধিকার রাজ্যগুলির ছিল, ‘এক দেশ, এক করব্যবস্থা’ চালু করতে গিয়ে রাজ্যগুলি তা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ফলে, প্রত্যাশা ছিল যে, জিএসটি পরিষদের মাধ্যমে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় পন্থায় এই করব্যবস্থা পরিচালিত হবে। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি, মূলত ক্ষুদ্র রাজনীতির প্রতি শাসকদের অদম্য আকর্ষণের কারণেই। বারে বারেই অভিযোগ উঠেছে, পরিষদে বিজেপির রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে যে, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কথাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যের নেতারা রাজ্যের আর্থিক স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন। মোট কথা, জিএসটি ব্যবস্থাটি যে পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠার কথা ছিল, তাতে বড়সড় ঘাটতি থেকে গিয়েছে। ফলে, প্রতিটি পদক্ষেপই তুমুল বিতর্কিত। এই অবিশ্বাস দূর করার দায়িত্ব শাসকপক্ষকেই নিতে হবে।
জিএসটির অন্য সমস্যা তার জটিলতা। দুনিয়ায় যত দেশে জিএসটি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে, ভারতের ব্যবস্থাটি সম্ভবত তার মধ্যে জটিলতম। বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে করের হার পৃথক— কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে শূন্য শতাংশ; হিরে ও গয়নার ক্ষেত্রে বিশেষ হার; স্বাভাবিক পণ্যের ক্ষেত্রে পাঁচ, বারো ও আঠারো শতাংশ; এবং, বিলাসপণ্য ও ‘সিন গুড’ বা অপপণ্যের জন্য করের হার আটাশ শতাংশ। অন্তিম পণ্য প্রস্তুত করতে যে অন্তর্বর্তী পণ্য প্রয়োজন হয়, তার এক-একটির উপর করের হার এক-এক রকম। একই গোত্রের বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে অনতিতাৎপর্যপূর্ণ ফারাকেও করের হারে বিপুল পার্থক্য আছে, এমন উদাহরণের সংখ্যাও কম নয়। ফলে, প্রধানমন্ত্রী যাকে ‘গুড অ্যান্ড সিম্পল ট্যাক্স’ বলেছিলেন, তা প্রকৃত প্রস্তাবে প্রবল জটিল। এই করব্যবস্থার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ইনপুট ক্রেডিট, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী পণ্যের উপর প্রদেয় করের টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা। বিভিন্ন কারণে সেই প্রক্রিয়াটিও কুশলী হতে পারেনি। শিল্পমহলের আরও একটি অভিযোগ যে, পেট্রল-ডিজ়েল জিএসটির আওতায় না থাকার কারণে তার পিছনে হওয়া খরচের উপর ইনপুট ক্রেডিট পাওয়া যায় না, ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে। কর আদায়ের পরিমাণও প্রত্যাশিত হারের তুলনায় কম হয়েছে, ফলে রেভিনিউ নিউট্রালিটির শর্তটিও পাঁচ বছরে পূরণ করা যায়নি।
২০১৭ সালে যখন জিএসটি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, তখন রাজ্যগুলির রাজস্ব বৃদ্ধির হার অন্তত ১৪ শতাংশ নিশ্চিত করার জন্য স্থির হয় যে, পরবর্তী পাঁচ বছর সেই রাজ্যগুলি জিএসটি খাতে ক্ষতিপূরণ পাবে। এই বছর জুন মাসে সে মেয়াদ ফুরিয়েছে। বিশেষত বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির দাবি মেনে ক্ষতিপূরণের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানো হবে, তেমন ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যায়নি। ফলে, রাজ্যগুলির রাজস্ব পরিস্থিতির উপর তার কী প্রভাব পড়বে, এখনও অনিশ্চিত। পাঁচ বছর পেরিয়ে বিভিন্ন দিকে এই অনিশ্চয়তাই জিএসটি ব্যবস্থার প্রকৃত অর্জন। ব্যবস্থাটিকে সফল করার জন্য প্রয়োজন ছিল যথাযথ পরিকল্পনার, এবং গণতন্ত্রের অনুশীলনের। দুর্ভাগ্য, এই জমানায় দু’টিই বিরল।