লাগাতার কর্মবিরতির পরে আমরণ অনশন। প্রতিবাদী জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবিগুলিকে সর্বান্তঃকরণে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে সমর্থন করার পরেও তাঁদের আন্দোলনের পথ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আর জি কর হাসপাতালে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার এবং এই ঘটনার সূত্র ধরে হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তার সুবন্দোবস্ত চেয়ে তাঁদের আপসহীন আন্দোলন অবশ্যই জরুরি। রাজ্য সরকার তথা শাসক শিবিরের নির্লজ্জ এবং নির্মম আচরণের কারণেই দ্বিগুণ জরুরি। কিন্তু দীর্ঘ ছয় সপ্তাহ কর্মবিরতি পালনের পরে আংশিক অব্যাহতি দিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে আবার পূর্ণ কর্মবিরতিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রতিবাদী চিকিৎসকদের একাংশের বিবেচনাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, তাঁদের নৈতিক অবস্থানকেও দুর্বল করেছিল। শেষ পর্যন্ত, ‘জনসাধারণের স্বার্থ’ রক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁরা কর্মবিরতি সম্পূর্ণ তুলে নেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন, কিন্তু তার চব্বিশ ঘণ্টা পরেই শুরু হল আমরণ অনশন। ফলত এখন আন্দোলনের পরিস্থিতিতে বড় আকারের জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, শারদোৎসবের পূর্বাহ্ণে ঘনিয়েছে গভীর দুশ্চিন্তার মেঘ। অনশনের পর্ব যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, সেই দুশ্চিন্তা আক্ষরিক অর্থেই প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে।
সন্দেহ নেই, অনশন, বিশেষত আমরণ অনশন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। শাসকের উপর গুরুতর চাপ সৃষ্টির হাতিয়ার। অনশনকে ‘আত্মশুদ্ধি’র উপায় হিসাবে, অহিংস প্রতিবাদের নৈতিক প্রকরণ হিসাবে ব্যবহারের পথ যিনি দেখিয়েছিলেন, সেই মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীও তার এই কার্যনির্বাহী শক্তি সম্পর্কে বিলক্ষণ সচেতন ছিলেন। সঙ্গত কারণেই বরাবর প্রশ্ন উঠেছে যে, চাপ সৃষ্টির এই হাতিয়ার খুব সহজে নৈতিকতার মহত্ত্ব হারিয়ে নিছক কার্যসিদ্ধির উপায় হয়ে দাঁড়ায় না কি? অনশন শুরুর মুহূর্তেই যখন জানিয়ে দেওয়া হয় যে এর পরে কোনও সমস্যা সৃষ্টি হলে তার জন্য সরকারই দায়ী থাকবে, তখন ওই প্রশ্নটিই অনিবার্য হয়ে ওঠে। নিজেদের সুস্থতা তথা জীবন বাজি রেখে এবং ভয়ঙ্কর কোনও পরিণতির ঝুঁকি তৈরি করে শাসককে নতিস্বীকারে বাধ্য করার পরিকল্পনা হিসাবেই কি এই আমরণ অনশন? কঠিন ও জটিল প্রশ্ন।
এমন পরিণতির পিছনে শাসকের দায় অবশ্যই অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁরা গোড়া থেকেই যে অপদার্থতা, নির্বুদ্ধিতা এবং অবিবেচনার প্রমাণ দিয়ে এসেছেন, এখনও তার বিরাম নেই। শনিবার ধর্মতলায় প্রতিবাদ মঞ্চ নির্মাণে বাধা দেওয়ার উদগ্র তৎপরতায় তা স্পষ্ট। উর্দিধারী বড়কর্তারা পরে অবস্থা সামাল দেওয়ার একটি দৃশ্য রচনা করেন বটে, কিন্তু তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিতান্তই কম। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা বিধানের মূল প্রশ্নে সরকারের গয়ংগচ্ছ ভাব এবং নানা ধরনের চালাকির চেষ্টা, যার স্বরূপ উত্তরোত্তর প্রকট হয়েছে। এমনকি সর্বোচ্চ আদালত একাধিক বার এই বিষয়ে রাজ্য সরকারকে কার্যত কৈফিয়ত চাওয়ার পরেও হাসপাতাল তথা স্বাস্থ্য প্রশাসনের যথার্থ সংস্কারের সৎ চেষ্টা এখনও দেখা যায়নি। গত সন্ধ্যায় মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ অনশনকারী ডাক্তারদের কাজে ফেরার বার্তা দিয়ে যে ‘আশ্বাস’ শুনিয়েছেন, সেটিও নেহাত দায়সারা। শাসকরা বিলক্ষণ জানেন যে তাঁদের উপর চাপ বাড়ছে। জন-আবেগের চাপ। মুখ্যমন্ত্রী নিজে সেই চাপের মহিমা মর্মে মর্মে জানেন, ওই বস্তুটিকে প্রধান প্রকরণ বানিয়েই তিনি এক দিন ক্ষমতায় এসেছিলেন। এখন তিনি উল্টোরথের সওয়ার। জুনিয়র চিকিৎসকদের আমরণ অনশন তাঁকে অভূতপূর্ব পরীক্ষায় ফেলেছে। এখন তিনি যতই বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে পুজো উদ্বোধনের ফিতে কাটতে থাকুন এবং ‘দু’একটা ঘটনা ঘটলেই চিৎকার-হাহাকার করা হচ্ছে’ বলে সেই বস্তাপচা ভাষায় ও সুরে উল্টো আক্রমণ শাণাতে তৎপর হোন, মহোৎসবের এই লগ্নটি যাতে মহাবিপদের লগ্ন হয়ে না দাঁড়ায় সেটা নিশ্চিত করার দায় তাঁকেই নিতে হবে। পালাবার পথ নেই।