Mamata Banerjee

জমির শর্ত

নির্বাচিত সরকার সকল জনসম্পদের অছি, তার সুরক্ষা এবং সদ্ব্যবহারই সরকারের কাজ। জনস্বার্থই সরকারের প্রধান বিবেচ্য, নিলামের সর্বোচ্চ দর পাওয়া নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২২ ০৫:৩৭
Share:

রাজ্য সরকার নতুন জমি-নীতি তৈরি করছে। প্রস্তাবটি চমকপ্রদ— কেএমডিএ, আসানসোল-দুর্গাপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটির মতো স্থানীয় প্রশাসনের অধীনস্থ ‘উদ্বৃত্ত’ জমি নিলামে তোলা হবে, এবং ক্রেতাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘লিজ়’-এ না দিয়ে সরাসরি ‘ফ্রি হোল্ড’ জমি হিসেবে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, সেই জমিকে ক্রেতা ইচ্ছেমতো যে কোনও কাজে লাগাতে পারবেন। শিল্প অথবা শপিং মল, যা ইচ্ছে করা যাবে, মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বিধানসভায় আলোচিত হয়নি। ফলে এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলি কী, কেনই বা কলকাতা বা দুর্গাপুরের অতি মূল্যবান জমি সরকার বাণিজ্যিক সংস্থাকে ইচ্ছেমতো ব্যবহারের জন্য দিতে চায়, কিছুই স্পষ্ট নয়। বর্তমানে যে সব জমি ‘লিজ়’ দিয়েছে সরকার, সেগুলোও ক্রমে-ক্রমে ‘ফ্রি হোল্ড’ ঘোষণা হবে কি না, তা এখনও অজানা। জমির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ‘নীতি’ নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় এমন অস্বচ্ছতা বড়ই অস্বস্তিকর। সরকারি আধিকারিকরা জানিয়েছেন, এর ফলে জমির ব্যবহারে বাধা ঘুচবে। শিল্প করার জন্য জমি লিজ়-এ নেওয়ার পরে দীর্ঘ দিন তা ফেলে রাখার নজির প্রচুর। কখনও শিল্প তৈরি করাই অলাভজনক মনে হয় ক্রেতা সংস্থার, কখনও শিল্প তৈরি করেও তাঁরা চালাতে পারেন না। শিল্প বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি নিয়ে সেখানে আবাসন বা শপিং মল তৈরি হয়েছে, এমন নিদর্শন কম নয়।

Advertisement

অতএব জমি ‘ফ্রি হোল্ড’ করার কিছু সুবিধা খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম, জমির ব্যবহারে বিলম্ব এড়ানো। জমি লিজ় নেওয়ার পর ব্যবহারের শর্ত বদলের অনুমোদন পাওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ, জটিল এবং প্রায়ই দুর্নীতি-পঙ্কিল। অতএব শর্ত আরোপ না করলে শিল্পপতিদের হয়রানি কম হবে। দ্বিতীয় সুবিধে, ফ্রি হোল্ড জমি নিলামে তুললে দাম অনেক বেশি পাবে সরকার। রাজ্যের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যার প্রয়োজন কম নয়। সর্বোপরি, শিল্প সংস্থাগুলিকে পশ্চিমবঙ্গে আকর্ষণ করার প্রতিযোগিতায় ‘ফ্রি হোল্ড’ জমি বড় টোপ হতে পারে। ভারতে সরকারি জমি ‘ফ্রি হোল্ড’-এ দেওয়ার নীতি বিরল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ‘এসইজ়েড’-এর বিরোধী— তা নিয়ে বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সঙ্গে সরকারের দীর্ঘ বিতর্ক চলছে। ২০১৭ সালে ইনফোসিস-কে প্রদত্ত জমির প্রায় অর্ধেক ‘ফ্রি হোল্ড’ করে দেয় রাজ্য সরকার। জমি ‘ফ্রি হোল্ড’ করার বিষয়টিকে আরও প্রসারিত করাকে শিল্পমহল স্বাগত জানাবে, জেনেই এই ঘোষণা।

কিন্তু জনস্বার্থ? কলকাতা বা দুর্গাপুরের জমি নিলামে তুলে সর্বোচ্চ দর-হাঁকা ক্রেতাকে বিক্রি করলে স্থানীয় মানুষের উন্নয়ন হবে কি না, তা নিশ্চিত হবে কী করে? কর্মসংস্থান, সুলভ আবাসন, উন্নত মানের উচ্চশিক্ষা, ভাল হাসপাতাল, এমনকি খেলাধুলো ও স্বাস্থ্যচর্চা— একটি আধুনিক শহরে সর্ব স্তরের মানুষের যা কিছু প্রয়োজন, সেগুলিই কি সরকারি জমির প্রধান দাবিদার নয়? যদি বিলাসবহুল আবাসন বা শপিং মল দরজা বন্ধ করে দেয় শহরের নিরানব্বই শতাংশ মানুষের মুখের উপরে, তাকে কি ‘উন্নয়ন’ বলা চলে? জমি ব্যবহারে সময়সীমা ও উন্নয়নের শর্ত, দুটোই ত্যাগ করলে কী থাকবে? নির্বাচিত সরকার সকল জনসম্পদের অছি, তার সুরক্ষা এবং সদ্ব্যবহারই সরকারের কাজ। জনস্বার্থই সরকারের প্রধান বিবেচ্য, নিলামের সর্বোচ্চ দর পাওয়া নয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement