মিড-ডে মিল এবং রেশন ব্যবস্থা, এই দুই প্রকল্পের সামাজিক নিরীক্ষণ বা ‘সোশ্যাল অডিট’ শুরু হতে চলেছে ডিসেম্বরে, জানিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। যে কোনও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কার্যকারিতা ও নিয়মানুবর্তিতা পরখ করতে সোশ্যাল অডিট অর্থাৎ স্থানীয় মানুষ তথা উপভোক্তাদের দ্বারা প্রকল্পের মূল্যায়ন অত্যন্ত আবশ্যক, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রশাসনের খাতায়-কলমে যে সব কাজ সারা হয়ে গিয়েছে, সরেজমিনে দেখলে বোঝা যায়, তার কতটুকু দুধ আর কতটা জল। সর্বোপরি, সরকারি প্রকল্প যাঁদের জন্য পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করা হয়, তাঁরা সেই সব পরিষেবায় কতটুকু সন্তুষ্ট, তাঁদের চাহিদা কতখানি মিটছে, সে বিষয়ে জানার অন্যতম উপায় সোশ্যাল অডিট। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বিভিন্ন প্রকল্পের সোশ্যাল অডিটের যে প্রশ্নপত্র তৈরি করে পাঠানো হয়, তার উত্তর পাওয়া গেলে, এবং সেই সব উত্তরপত্রের ভিত্তিতে সংশোধনের উদ্যোগ করা গেলে, অর্থের অপচয় বন্ধ হত এবং পরিষেবার মান উন্নত হত, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আক্ষেপ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সোশ্যাল অডিটের প্রক্রিয়াটাই অস্বচ্ছ এবং পরিণামহীন হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, ইতিপূর্বে বেশ কয়েক বছর মিড-ডে মিলের সোশ্যাল অডিট হয়েছে। কিন্তু সেই সব অডিটে মিড-ডে মিলের পুষ্টিগুণ, পরিচ্ছন্নতা বা হিসাবরক্ষার কী চিত্র মিলেছে, এবং তার সংশোধনের জন্য কী করা হয়েছে, সে বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি বিষয়ে না জানতে পেরেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ, স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি অথবা অভিভাবকরা, না জানতে পারছে বৃহত্তর জনসমাজ। ফলে পুরো বিষয়টি নিষ্প্রাণ নিয়মরক্ষায় পর্যবসিত হচ্ছে। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত রেশন ব্যবস্থা। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বিপুল দুর্নীতির যে অভিযোগ সামনে এসেছে, সোশ্যাল অডিটে তা ধরা পড়েছিল কি না, পড়লে কেন প্রতিকার হয়নি, সে প্রশ্নগুলো অতিকায় হয়ে ওঠে।
এমন উদাহরণ প্রায় প্রতিটি জাতীয় প্রকল্পে। সোশ্যাল অডিটের প্রক্রিয়াকে কার্যত অচল করে রাখার সবচেয়ে বড় ক্ষতি সম্ভবত বহন করছেন একশো দিনের কাজের প্রকল্পের জব কার্ড গ্রাহকরা। চার বছর এই প্রকল্প বন্ধ রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। সোশ্যাল অডিট এই প্রকল্পের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। নিয়মানুসারে, গ্রামে কী কাজ হয়েছে, তার প্রতিবেদন গ্রাম সভায় পেশ করে সকলের সম্মতি নিতে হবে। কিন্তু দলীয় রাজনীতি তার প্রভাব বিস্তার করে স্বচ্ছ মূল্যায়নের পথ অবরুদ্ধ করেছে। রিপোর্ট তৈরি এবং জমা পড়েছে গ্রামবাসীর অজানতে। তার ফলে চার বছরে বিপুল অর্থ হারিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সরকারি আবাসন প্রকল্পের মূল্যায়ন করতে গিয়ে হুমকির চাপে এক মহিলাকর্মী আত্মহত্যাও করেছেন। সোশ্যাল অডিট কর্মীদের এমনই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। অথচ, প্রাতিষ্ঠানিক অস্বচ্ছতা এবং নিষ্ক্রিয়তা কেবল গ্রাহকদের স্বার্থহানি করে না, ঝুঁকি বাড়ায় প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিরও। যে স্কুলে চাল সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা নেই, বা রান্নাঘরটি ভাঙাচোরা, সেখানে চালে পোকা, ইঁদুর কিংবা ছত্রাকের আক্রমণ, কিংবা রান্না-করা খাবারে পোকার উপস্থিতি অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে অভিভাবকদের চোখে দোষী হন রন্ধনকর্মী, শিক্ষক, চাল সরবরাহকারী ব্যবসায়ীরা।
অতএব সোশ্যাল অডিট-এর প্রক্রিয়া তখনই অর্থপূর্ণ হতে পারে, যখন তা পরিষেবার বিষয়ে নাগরিকের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন করে, এবং তার দ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। গণতান্ত্রিক প্রশাসনে দু’ভাবে নাগরিকের অংশীদারি আনা হয়েছিল, এলাকার উন্নয়নের পরিকল্পনায় নাগরিকের অংশগ্রহণে, এবং উন্নয়নের প্রকল্পের মূল্যায়নের কাজে তাঁদের অংশগ্রহণে। তীব্র আক্ষেপের কথা, গত দেড় দশকে পশ্চিমবঙ্গ-সহ প্রায় সব রাজ্যে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারগুলি প্রশাসনে নাগরিকের ভূমিকাকে প্রান্তিক, এমনকি অনভিপ্রেত করে তুলেছে।