New Delhi Railway Station Stampede

পরমায়ুপ্রার্থী

পুণ্যার্জন ও পরমায়ু-প্রার্থনার অভিলাষ নিয়ে যাঁরা ঘর থেকে বেরিয়ে তীর্থাভিমুখে যাত্রা করেছিলেন, তাঁদের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুর উপঢৌকন নিয়ে এল ২০২৫ সালের ভারত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৪:৩৫
Share:

কয়েক দিন আগে দিল্লি স্টেশনে ভয়ঙ্কর ভাবে পদপিষ্ট হয়ে অন্তত আঠারো জন কুম্ভযাত্রী মানুষের প্রাণ চলে গেল এবং আরও বহু সংখ্যক আহত-ক্ষতবিক্ষত হলেন: সেই সংবাদে রীতিমতো শিউরে উঠেছে সারা দেশ। পুণ্যার্জন ও পরমায়ু-প্রার্থনার অভিলাষ নিয়ে যাঁরা ঘর থেকে বেরিয়ে তীর্থাভিমুখে যাত্রা করেছিলেন, তাঁদের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যুর উপঢৌকন নিয়ে এল ২০২৫ সালের ভারত। এই ভারতের কিন্তু অজানা ছিল না যে, এই বছর মহাকুম্ভের ঋতুতে অগণিত মানুষ এমন ভাবে পাগলপারা যাত্রায় শামিল হবেন, ভিড়ের চাপ অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছতে পারে, রেলস্টেশনে এমনই অব্যবস্থার উদয় হতে পারে। কিন্তু এত কিছু জানার পরেও যথাযোগ্য সাবধানতা নেওয়া হয়নি, শৃঙ্খলারক্ষার কোনও বিবেচনাই করা হয়নি, একই সঙ্গে একাধিক ট্রেনের যাত্রাসূচি স্থির করে চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে, এমনকি শেষ মুহূর্তে কোন প্ল্যাটফর্মে কোন ট্রেন আসছে তা নিয়ে বিরাট অস্পষ্টতা তৈরি করে মানুষের ক্লেশ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। যে স্বামী ভিড়ের মধ্যে স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলে ফিরে পেলেন কেবল মৃতদেহ, যে সন্তানের কাছে নিয়ে আসা হল তার নিথর মা বা বাবার শরীর, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ভারতীয় রেলওয়ের কর্তাব্যক্তিরা কি এক বার উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন, তাঁদের নিদারুণ অবিবেচনার ফল কার জীবনে কী ভাবে অভিশাপ হয়ে নেমে এল? না কি তাঁরা ভাববেন, ক্ষতিপূরণ ধরিয়ে দেওয়াই তো যথেষ্ট, সাধারণ মানুষের প্রাণের দাম এর বেশি আবার হয় না কি?

Advertisement

দিল্লির ঘটনাটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র। চূড়াটি দেখা গেল বলে সমগ্র দেশে ব্যাপ্ত রেল-বিশৃঙ্খলার বিষয়টি নিয়ে অন্তত কিছু আলোচনা শোনা যাচ্ছে। না হলে কুম্ভযাত্রীবাহী ট্রেনের চলাচলে একের পর এক অন্যান্য ট্রেন বাতিল হওয়ার ঘটনা, কিংবা যদৃচ্ছ বিলম্বিত ও অনির্দিষ্ট সময়ে চলাচল, এবং তজ্জনিত যাত্রী ভোগান্তি— ভারতীয় নাগরিক এ সব নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন, ভাবা প্র্যাকটিস করেছেন যে এ-ই তাঁদের প্রাপ্য। এর থেকে বেশি পেতে হলে পুণ্য প্রয়োজন বলেই তাঁরা এমন দিগ্‌ভ্রান্ত পুণ্যার্জন-পিয়াসি হয়ে ওঠেন। ভারতীয় রেলওয়ে এক দিন দেশের গৌরব ছিল। সেই ট্র্যাডিশন কবেই অস্তমিত। একের পর এক লাইনচ্যুতি, বীভৎস দুর্ঘটনা, অগণিত প্রাণহানি দেখে দেখে এখন ট্রেনে চড়তে গেলে যাত্রীরা মাত্র সামান্যই প্রত্যাশা করেন— জীবন নিয়ে প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা।

এ বছরের মহাকুম্ভ-চিত্রপটের মধ্যে প্রবল হয়ে রইল মানুষের হিংস্রতার কিছু মুহূর্ত। অবিস্মরণীয় আক্রমণ আছড়ে পড়তে দেখা গেল বিভিন্ন কুম্ভগামী ট্রেনের উপর। সেই চলচ্ছবি ইতিমধ্যে সমাজমাধ্যমে বহুলপ্রচারিত। কেন আর সব ছেড়ে ট্রেনের উপরেই এই আক্রমণ? রেলওয়ে নামক জাতীয় সম্পত্তির প্রতি কত কম সম্মানবোধ থাকলে এই ঘটনা ‘পুণ্যার্থী’রা ঘটাতে পারেন, জাতির নেতারা কি তা নিয়ে এক বারও ভাবছেন? গোটা দুনিয়ায় এই সব ছবি কী ভাবে জাতির মুখোজ্জ্বল করছে, তা নিয়ে ভাবছেন? অথচ এখানেও তাঁদের দায় ও দায়িত্ব বিরাট। জনগণের এমন হিংসাত্মক ভাব বুঝিয়ে দেয়, নিরাপত্তাবোধ ও সুস্থযাপনের আশা কতটা অন্তর্হিত হলে মানুষ এমন বেপরোয়া ভাঙচুর করতে পারে। নিজেদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে আড়াল করে ভিড়ের উন্মত্ততাকে দোষ দেওয়া অতি সহজ। সেই সহজ কাজটিই এই মুহূর্তে করে চলেছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। তাঁদের ভাবটি এই, সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে কেশাগ্র ভ্রান্তি নেই, যত উদ্‌ভ্রান্তি মানুষের চরিত্রে। তাঁদের যদি মনে করিয়ে দেওয়া যেত শতবর্ষ-অতিক্রমী ‘কালকূট’ সমরেশ বসুর কুম্ভযাত্রীদের নিয়ে সেই পর্যবেক্ষণ: টাকা যাদের নেই, সম্বল নেই, তারা কি তীর্থটুুকুও শান্তিতে স্বস্তিতে করতে পারবে না?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement