সাতচল্লিশ বছর আগে যে দিনটিতে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, অতর্কিত পুলিশি হানায় বন্দি হয়েছিলেন বহু বিরোধী রাজনীতিক, সেই তারিখেই মুম্বইয়ে সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাদের বাড়িতে হানা দিয়ে গুজরাত পুলিশ তাঁকে আটক করল, একই দিনে আমদাবাদে গ্রেফতার হলেন গুজরাতের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার আর বি শ্রীকুমার। প্রসঙ্গত, দু’জনেই ২০০২ সালে গুজরাতের ভয়াবহ ঘটনাবলির জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর সরকারের প্রবল সমালোচক ও প্রতিপক্ষ। সমাপতন কেবল তারিখের নয়। দু’টি ক্ষেত্রেই ২৫ জুনের ঘটনার সঙ্গে আদালতের ভূমিকা জড়িয়ে আছে। তবে ভূমিকাটি এক রকম নয়, বরং এক অর্থে বিপরীত। ১৯৭৫-এ ইলাহাবাদ হাই কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের ফলে ঘনিয়ে আসা মহাসঙ্কট থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। ২০২২-এ সুপ্রিম কোর্ট কুড়ি বছর আগে গুজরাতের মর্মান্তিক গণনিধনের ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদীকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়ার বিরুদ্ধে আনীত আবেদন খারিজ করে দেয়, অর্থাৎ আদালতের রায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্কট মোচন করেছে। কিন্তু সেই সূত্রেই আদালত জানিয়ে দেয়, ‘অন্য কোনও উদ্দেশ্যে’ বিষয়টিকে জিইয়ে রাখতে যাঁরা ওই আবেদন করেছেন এবং নিজেদের ক্ষোভের কারণে গুজরাত সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ করা উচিত। এই বিচারের বাণীকে হাতিয়ার করেই অতঃপর গুজরাত পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে পরাক্রমী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদালতের রায়ের সূত্র ধরে ‘নীলকণ্ঠ’ প্রধানমন্ত্রীর বন্দনা গেয়েছিলেন। সমাপতন?
আদালত মহামান্য। বিচারপতিরা আপন ন্যায়বোধ প্রয়োগ করে সুবিচার করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। তিস্তা শেতলবাদ ও অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যাসত্য বিষয়ে মন্তব্য করলে সেটা হবে অনধিকার চর্চা। কিন্তু বিরোধী মত ও পথের অনুসারীদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় অভিযানের সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত বিষয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি। কেবল তিস্তা বা শ্রীকুমার নন, সঞ্জীব ভট্ট থেকে রানা আইয়ুব অবধি আরও বিভিন্ন নাম গত দু’দশকের গুজরাতের ইতিহাস থেকে উঠে আসে, যাঁরা সবাই মোদী ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সরব ও সক্রিয় হয়েছেন এবং যাঁদের মাথার উপর রাষ্ট্রশক্তির কোপ পড়েছে, যে রাষ্ট্রের নায়ক মোদী। সমাপতন? এবং, এই ধারা ২০০২-এর ইতিহাসে সীমিত থাকেনি, বারংবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। মাত্র দু’মাস আগে গুজরাতের কংগ্রেস-সমর্থিত নির্দল বিধায়ক, দলিত রাজনীতির তরুণ নেতা জিগ্নেশ মেবাণীকে বিজেপি-শাসিত অসম পুলিশে দায়ের করা এক নালিশের ভিত্তিতে আটক করা হয়। সমাপতন?
মোদী-শাসিত গুজরাত থেকে এই সমাপতন গত আট বছরে মোদী-শাসিত ভারতে প্রসারিত হয়েছে। সেই প্রসরণের বিরাম নেই— তিস্তা শেতলবাদের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে দেশে ও দুনিয়ায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ জমে ওঠার মধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন এক ওয়েবসাইটের সাংবাদিক মহম্মদ জ়ুবের। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, আবারও, আদালত বিচার করবে, কিন্তু নাগরিক খেয়াল করতে ভুলবেন না যে— ভুয়ো খবর ধরার কাজে ব্রতী ছিল এই ওয়েবসাইট, সুতরাং তার অবস্থান শাসকদের প্রতিকূল, কারণ এ-দেশে ভুয়ো খবর নির্মাণ ও প্রচারের অভিযোগ প্রধানত শাসক শিবিরের বিরুদ্ধেই। কার্যত প্রতি দিনই এমন হানাদারির নতুন নজির তৈরি হচ্ছে। পরিস্থিতি এমনই যেখানে শাসকের বিরুদ্ধে, বিশেষত রাষ্ট্রের শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কেউ রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসার শিকার না হলে সেটাই বিস্ময়ের কারণ। জরুরি অবস্থা জারি না করেও তার লক্ষণগুলিকে চরিতার্থ করতে পেরেছেন— নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সতীর্থদের এই কৃতিত্ব বাস্তবিকই তুলনাহীন।