national flag

চৌকিদারের শাসন

এখানেই তেরঙা নিয়ে বর্তমান শাসককুল এবং তাঁদের সতত-উদ্বাহু ভক্তবৃন্দের উদগ্র তৎপরতার মৌলিক সমস্যা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২২ ০৭:১৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস লিখেছিলেন, ‘এক পূর্বাভাসিত মৃত্যুর বৃত্তান্ত’। জাতীয় পতাকা না-তোলার দায়ে কাশ্মীরে কয়েক জন সরকারি স্কুলশিক্ষককে সাসপেন্ড করা হয়েছে— এই ঘটনাটিও কি অবধারিত ছিল না? ল্যাটিন আমেরিকার উপন্যাসের সঙ্গে ভারতীয় বাস্তবের ফারাক অবশ্যই আছে। সাসপেনশন মৃত্যু নয়; এই কঠিন সময়ে জীবিকা হরণের আদেশ মৃত্যুদণ্ডের শামিল হলেও দুটো শাস্তিকে নিশ্চয়ই এক করে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া, জাতীয় পতাকা না তুললে শাস্তি দেওয়া হবে, এমন কোনও হুকুমও প্রধানমন্ত্রী জারি করেননি, তিনি কেবল হাঁক দিয়েছিলেন: ‘হর ঘর তিরঙ্গা’। কিন্তু বহিরঙ্গের পার্থক্য সরিয়ে সেই ঘোষণার প্রেক্ষাপটের দিকে নজর করলে এক গা-ছমছমে সাদৃশ্যের আদল খুঁজে পাওয়া যায় বইকি, যার সূত্র ধরে রচিত হতে পারে এক পূর্বাভাসিত সাসপেনশনের বৃত্তান্ত। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে, নবনামাঙ্কিত অমৃত মহোৎসবে ঘরে ঘরে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর ‘আবেদন’ যখন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নরেন্দ্র মোদীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, তখনই ভূয়োদর্শী নাগরিকের চিত্তে মেঘ ঘনিয়েছিল— এই আদেশ অমান্য করার দায়ে না-জানি কত লোককে শাস্তি পেতে হয়। আর, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গোটা দেশেই তেমন আশঙ্কা থাকে বটে, তবে কোথায় তার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, সে-প্রশ্নের ঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। অতএব, উপত্যকার বাটওয়ারি এলাকার ওই শিক্ষকদের শাস্তির খবর শুনে বিস্ময়ের কোনও অবকাশ নেই।

Advertisement

কেন্দ্রশাসিত কাশ্মীরের প্রশাসনের বক্তব্য পরিষ্কার। তারা সরকারি স্কুলে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তেরঙা ওড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিল, এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সেই আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া যায়, প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ মেলে, অতএব শাস্তির নির্দেশ। সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা সরকারি নির্দেশ না মানলে সরকারি কর্তারা তাঁদের জবাবদিহি চাইবেন, বা ভর্ৎসনা করবেন, এই পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে বোঝা যায়। কিন্তু এই ‘অপরাধ’-এ একেবারে সাসপেনশন? এমন বিচারের নমুনা দেখে এই অনুমান অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে ওঠে যে, কর্তারা জাতীয় পতাকার মর্যাদা নিয়ে যতটা চিন্তিত, তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তিত নিজেদের দাপট জারি রাখতে। বস্তুত, এখানেই ওঠে গভীরতর প্রশ্নটি। সরকার জাতীয় পতাকা তোলার ‘আদেশ’ জারি করবে কেন? স্বাধীনতা দিবসে তেরঙা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত তো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীন সিদ্ধান্ত, সেই স্বাধীনতা সরকারি স্কুলেরও ষোলো আনা প্রাপ্য, সরকারি স্কুল তো সরকারি প্রশাসনের দফতর বা পুলিশের থানা নয়!

এখানেই তেরঙা নিয়ে বর্তমান শাসককুল এবং তাঁদের সতত-উদ্বাহু ভক্তবৃন্দের উদগ্র তৎপরতার মৌলিক সমস্যা। তাঁরা জাতীয় পতাকার মর্যাদা বা গুরুত্ব নিয়ে কতটুকু ভাবিত, সে-কথা বলা অত্যন্ত কঠিন। স্বাধীনতা দিবস চলে যাওয়ার পরে দেশের নানা স্থানে ভূলুণ্ঠিত এবং যত্রতত্র স্তূপাকার নিশানটির যে-সব ছবি সংবাদমাধ্যমে দেখা গিয়েছে, তাতে যে কোনও সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের লজ্জিত হওয়ার কথা, অথচ শাসকবর্গের মুখে এই বিষয়ে সামান্য আক্ষেপও শোনা গিয়েছে কি? অনুমান, আপাতত তাঁদের পতাকা-ভজনার প্রয়োজন ফুরিয়েছে, আবার যখন প্রয়োজন হবে তখন কম্বুকণ্ঠে আহ্বান প্রচারিত হবে। এই শাসকদের অভিধানে শ্রদ্ধা, মর্যাদা বা দেশপ্রেম শব্দগুলির যথাযথ অর্থ লেখা থাকলে তাঁরা জানতেন যে, দেশপ্রেম কোনও ‘সবক শেখানো’র ব্যাপার নয়, জাতীয় পতাকা বা দেশমাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গদি থেকে হুকুম দিয়ে নির্মাণ করা যায় না, তা কেবল স্বাধীনচিত্ত নাগরিকের চেতনাতেই সঞ্জাত হতে পারে। ভয় দেখিয়ে চৌকিদারের শাসন চলে, গণতন্ত্রের শাসন নয়। কি কাশ্মীরে, কি অবশিষ্ট ভারতে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement