অতিমারি-দীর্ণ অলিম্পিক্স হইতে যে ফলাফল করিয়া ফিরিলেন ভারতীয় খেলোয়াড়েরা, তাহা ঐতিহাসিক, প্রবল অভিনন্দন-যোগ্য। খাতায়-কলমে ইহা ভারতের সেরা অলিম্পিক্স পারফরম্যান্স— সর্বমোট সাতটি পদক আসিয়াছে, ২০১২ অপেক্ষা একটি অধিক। তবে, এই সাফল্যের পূর্ববর্তী অন্ধকার পর্বটিকেও ভুলিলে চলিবে না। চোটের কারণে ২০১৯ সালটি ময়দানের বাহিরেই কাটিয়াছিল নীরজ চোপড়ার; সুস্থ হইতে না হইতেই কোভিডের প্রাদুর্ভাব, আরও একটি বৎসর ঘরে বসিয়াই কাটে, চার মাস পূর্বে ইউরোপে প্রশিক্ষণ লইবার সুযোগ আসে। কোভিডে আক্রান্ত হইবার ফলে অলিম্পিক্স-পূর্ববর্তী প্রশিক্ষণে যাইতে বিলম্ব হয় লাভলিনা বড়গোহাঁইয়ের, দমের সমস্যাও দেখা দেয়, শেষ মুহূর্তে সারিয়া উঠেন তিনি। গল্ফে চতুর্থ স্থানাধিকারী অদিতি অশোক কোভিড-পরবর্তী অসুখে ভুগিতেছেন, দৈহিক বলের অভাবে শটের জোর কমিয়াছে। এই অলিম্পিক্সে দেশ চিরশ্রেষ্ঠ ফল করিয়াছে, তুমুল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও।
পদকসংখ্যার ন্যায় ভারতীয় ক্রীড়ার সামগ্রিক অগ্রগমনের হিসাবটিও কষিতে হয়। যথা, মহিলা হকি দল পদক না পাইলেও গ্রুপ লিগে তেরো গোল করা অস্ট্রেলিয়াকে হারাইয়াছে। যে দল চার বৎসর পূর্বেও মাত্র তিনটি ম্যাচে বিধ্বস্ত হইয়া দেশে ফিরিয়াছিল, তাহারা এই বার বিশ্বসেরা পাঁচ দলের সহিত সমানে লড়িল, পদক জিতিবার পথটির সন্ধানও হয়তো পাইল। রুপা লইয়া রবি কুমার দাহিয়া বা ব্রোঞ্জ লইয়া লাভলিনা যথেষ্ট খুশি নহেন; আগামী দিনে তাহাকে স্বর্ণের ঔজ্জ্বল্যে বদলাইয়া দিতে বদ্ধপরিকর। আবার, যে খেলায় কখনও কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডিও পার করিতে পারিত না ভারত, তাহাতেই উপর্যুপরি তিনটি অলিম্পিক্সে পদক আসিয়া গেল পিভি সিন্ধু ও সাইনা নেহওয়ালের সৌজন্যে। ‘যে দেশ আটটি অলিম্পিক্সে হকিতে সোনা জিতিয়াছে’— বরাবরের এই তকমা ছাপাইয়া এই বার আগাইবার সুযোগ আসিয়াছে। যথাযথ অনুশীলনের সুযোগ, সুচিন্তিত পরিকল্পনা, এবং কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার ফলে।
খেলোয়াড়দের নেপথ্যে যে কারিগরেরা রহিয়াছেন, এই আনন্দের মুহূর্তে তাঁহাদেরও স্মরণ করা বিধেয়। সরকার, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরের ক্রীড়া সংস্থা এবং বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন— এই সাফল্যে অনেকেরই ভূমিকা আছে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুতেই অতি দ্রুত আমেরিকায় প্রেরণ করা হয় মীরাবাই চানুকে; প্রশিক্ষণের জন্য অনেক দিন রাশিয়ায় থাকিবার বন্দোবস্ত হয় বজরং পুনিয়ার; মসৃণ প্রস্তুতি-পর্বের জন্য গোটা তিরন্দাজি দলকে ক্রোয়েশিয়া পাঠাইয়া দেওয়া হয়। নীরজ বলিয়াছেন, প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের দাবি জানাইতে তাঁহাকে ফ্রান্স, সুইডেন ও ফিনল্যান্ড যাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হয়। খেলা সূচনার পূর্বেই প্রতিটি রাজ্য সরকার কর্তৃক ঘোষিত অর্থমূল্যের পুরস্কারের কথাও উল্লেখ করিতে হয়। বস্তুত, ক্রীড়া প্রশাসন খেলোয়াড়দের প্রয়োজনানুসারে দায়িত্ব পালন করিলেই ফললাভের পথটি সহজতর হয়। জয়ের ক্ষুধা বহু জনেরই থাকে, অতীতেও ছিল, কিন্তু প্রাণিত করিবার ন্যায় উদাহরণ থাকিতে হয়। টোকিয়ো তাহাই নির্মাণ করিল। ভারতবাসীর আশীর্বাদ এই কৃতীদের উপর বর্ষিত হউক।