কতটা দায় এড়ালে তবে পুলিশ হওয়া যায়? কলকাতা পুলিশের ক্ষেত্রে এমন কথাই যে এখন সর্বাধিক প্রযোজ্য, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বেহালার দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনার পরে পুলিশের ভূমিকা। পথ-দুর্ঘটনা নানা কারণে, নানা গাফিলতি ও অসাবধানতায় হতে পারে। স্কুলের সামনে বাবার সঙ্গে রাস্তা পেরোতে গিয়ে লরির ধাক্কায় দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়া ছোট ছেলেটির মৃত্যু অতি হৃদয়বিদারক, সান্ত্বনার অতীত এক দুর্ঘটনা। কিন্তু ভোরের কলকাতায় পুলিশ নেই, পুলিশ থাকে না, অন্তত সব স্কুলের সামনে বা কাছাকাছি থাকে না— সাধারণ মানুষের এই অভিযোগ কি পুলিশের ভয়ঙ্কর ও অবিশ্বাস্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ নয়? পুলিশের পরিচয় শুধুই ‘অন্যতম জরুরি পরিষেবা’ নয়, সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, শান্তি, শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি প্রতি মুহূর্তের কাজ, এবং সেই কাজে বিন্দুমাত্র ঢিলেমি ব্যতিরেকে অবিরল অনর্গল নজরদারিই যে পুলিশের দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা, এই কথাগুলো কি বারংবার সমাজ বা সংবাদমাধ্যমকেই মনে করিয়ে দিতে হবে? মহানগরের হাজার হাজার শিশু যখন স্কুলমুখী, সকালবেলার মতো সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যে স্বাভাবিক ভাবেই আরও বেশি, সবচেয়ে বেশি তৎপর হওয়া দরকার— দুর্ঘটনায় এক-একটি শিশুর প্রাণের মূল্যেই কি সেই শিক্ষা পাবে কলকাতা পুলিশ, নচেৎ নয়?
একদা এই সব দক্ষতা কলকাতা পুলিশের অধিগত ছিল। শুক্রবারের ঘটনায় পুলিশের অভিযোগ— উত্তেজিত জনতা দুর্ঘটনার পরেও দীর্ঘ সময় শিশুর দেহটিকে রাস্তা থেকে সরাতে দেয়নি, পুলিশের উপর চড়াও হয়েছে, পুলিশের গাড়ি উল্টে আগুন ধরিয়েছে, পুলিশ গার্ডের কার্যালয় ভাঙচুর করেছে, এমনকি পুলিশি হেফাজতের টাকা লুটও করেছে। উত্তেজিত ও বিশৃঙ্খল জনতা প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে নিন্দনীয় কাজ করে থাকে। এই ক্ষেত্রেও তাই। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, সম্প্রতি এলাকায় অন্য ক্ষেত্রে পুলিশ কড়াকড়ি করায় কিছু মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন, এই সুযোগে তাঁরা গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য যে, স্কুলের সামনে ট্র্যাফিক সামলানোর ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতাও ধারাবাহিক। যদি সকালবেলা স্কুলের সামনে গাড়ির গতি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা যেত, শিশুদের রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে নজরদারি থাকত, তা হলে হয়তো এই দুর্ঘটনাটি এড়ানো যেত, বহুলাংশে কমানো যেত এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা। এই কাজগুলি কঠিন নয়, অসম্ভব তো নয়ই— তার চেয়েও বড় কথা, এগুলিই পুলিশের আসল কাজ, বিশেষত যেখানে বিপুল সংখ্যক শিশুর জীবনের প্রশ্নটি জড়িয়ে। যে পুলিশ এই কাজটুকুও করতে পারে না তারা শুধু দায়িত্ব পালনে অদক্ষ, অপেশাদার ও চূড়ান্ত ব্যর্থই নয়, তারা অপরাধী— যে গাফিলতিতে মানুষের প্রাণ চলে যায়, তা কি অপরাধ নয়?
দুর্ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতেও পুলিশ যা করল, তা-ও শৃঙ্খলা ফেরানোর নয়, বিশৃঙ্খলা বাড়ানোর অনুঘটক: লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল। পরে হাজির হয়েছে বিরাট পুলিশ বাহিনী, অর্থাৎ সেই বাহুবলেই কার্যোদ্ধার। কলকাতা পুলিশ এক কালে জানত এবং মানত যে, আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষা মানে সাধারণ মানুষকে ভয় পাওয়ানো বা চটিয়ে দেওয়া নয়, তাকে সঙ্গী করে, তার প্রয়োজনটি বুঝে ও শুনে চলা, পাশে এসে দাঁড়ানো! পুলিশ কমিশনারের বিবৃতি, পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর সান্ত্বনা-ফোন, সরকারি দায়িত্বে আহতের চিকিৎসা, নিহতের পরিবারকে প্রয়োজনে চাকরি— এই সবই এক-একটি দুর্ঘটনার পরে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু কলকাতার ট্র্যাফিক ব্যবস্থার অনিয়ম-বেনিয়ম তাতে বিন্দুমাত্র ঢাকা পড়ছে না। সমাজমাধ্যমে কলকাতা পুলিশের মসিহাপ্রতিম গৌরবগাথা ভেসে ওঠে প্রায়ই, তাতে বাহবাও মেলে। রোজকার শহরজীবনের বাস্তবটি যে সম্পূর্ণ বিপরীত, সেই সত্যে তাদের হুঁশ ফেরাবে কে, আর একটি দুর্ঘটনা?