নির্বাচন আসিবে-যাইবে। কোনও রাজ্যে শাসনক্ষমতায় বদল হইবে, কোথাও পূর্বতন শাসকই ফের ক্ষমতায় ফিরিবেন। কিন্তু, দেশের কোনও রাজ্যে একটি কথা পাল্টাইবে না— রাজ্য চালাইতে অর্থের প্রয়োজন। জিএসটি ব্যবস্থার প্রবর্তনের পর যে হেতু রাজ্যগুলির নিজস্ব রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা অতি সীমিত হইয়াছে, ফলে রাজ্যের প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচির ব্যয়নির্বাহ করিতে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নির্ভরশীলতাও বাড়িয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি সেই অর্থের ব্যবস্থা না করিতে পারে, রাজ্যগুলির পাওনা যদি বকেয়া থাকিয়া যায়, তবে তাহা সরাসরি উন্নয়নের উপর আঘাত— রাজনীতির অঙ্কে সেই ক্ষতির পরিমাপ করা চলিবে না। নির্বাচনে যদি শাসক পাল্টাইয়া যায়, তাহাতেও রাজ্যের অর্থনীতির বিগত ক্ষতিগুলির সুরাহা হইবে না। গত এক বৎসরে এই ক্ষতির পরিমাণ ক্রমবর্ধমান। গত মাসের হিসাবে দেখা যাইতেছে, রাজ্যগুলির ২০২০ অর্থবর্ষের এপ্রিল হইতে নভেম্বর মাসের জিএসটি ক্ষতিপূরণবাবদ প্রাপ্য ২.০৬ লক্ষ কোটি টাকা বকেয়া থাকিয়া গিয়াছে। তাহার পরের মাসগুলির ক্ষতিপূরণের টাকা কবে মিলিবে, তাহারও ঠিক নাই। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে টাকা ধার করিয়া লইতে বলিয়াছে। কিন্তু, সেই ধারের দায় বহন করিবে কে, সেই প্রশ্নটিরও ফয়সালা হয় নাই। গত অগস্টে প্রধানমন্ত্রীর সহিত ভিডিয়ো বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করিয়াছিলেন, কেন্দ্রের নিকট পশ্চিমবঙ্গের মোট বকেয়ার পরিমাণ ৫৩,০০০ কোটি টাকা। সেই টাকা যদি রাজ্যের হাতে না আসে, তবে উন্নয়নের কাজ স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। তাহাতে বিরোধী রাজনীতির সুবিধা হইতে পারে, রাজ্যবাসীর বিলক্ষণ ক্ষতি।
গোটা দেশ যখন লকডাউনের ধাক্কায় ধরাশায়ী, তখন পশ্চিমবঙ্গের উপর আক্ষরিক অর্থে আরও একটি প্রলয়ঙ্কর ঝড় বহিয়া গিয়াছিল। আমপান এই রাজ্যের এক বিপুল জনগোষ্ঠীকে বিধ্বস্ত করিয়াছে। সেই ক্ষতি পূরণ করিতেও অর্থের প্রয়োজন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে আসিয়া বলিয়া গেলেন, আমপানের ত্রাণবাবদ রাজ্যকে ১০,০০০ কোটি টাকা দেওয়া হইয়াছে। তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতার প্রতি ইঙ্গিত করিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলিলেন, টাকাটি তিনিই হাত করিয়া লইয়াছেন। সত্যই যদি রাজ্যে ত্রাণবাবদ টাকা আসিয়া থাকে, এবং সত্যই যদি সেই টাকা নয়ছয় হইয়া থাকে— সুবিচার হওয়া প্রয়োজন। তবে অদ্যাবধি যে হিসাব গণপরিসরে আছে, তাহা অবশ্য শ্রীশাহের দাবির এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্যের আমপান-বিধ্বস্ত এলাকায় হেলিকপ্টার পরিদর্শন সারিয়া ১,০০০ কোটি টাকা সাহায্যের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; এবং ঝড়ের ছয় মাস পরে, নভেম্বরের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আরও ২,৭০৮ কোটি টাকা দিয়াছিল। বাকি ৬,২৯২ কোটি টাকার হিসাব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পেশ করিলে তবেই রাজ্য সরকারকে চাপিয়া ধরা যাইবে। অবশ্য সেই হিসাব সত্যই থাকিলে অভিযোগ করিবার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি নির্বাচনী জনসভার অপেক্ষায় থাকিতেন?
সুতরাং, আশঙ্কার বিলক্ষণ কারণ আছে। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাহা বলিয়াছেন, তাহা নির্বাচনী প্রচারের বুলিমাত্র। রাজনীতির বুলি। রাজনীতিকরা রাজনীতি করিয়াই থাকেন— বিষয়বস্তু নির্বিচারেই করেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গবাসীকে এই বার ভাবিতে হইবে, আমপানের ন্যায় এক প্রলয়ঙ্কর ঝড়ে রাজ্যের বিপুলসংখ্যক মানুষ সর্বস্বান্ত হইবার পরও যে সাহায্য আসে নাই, তাহাকেই প্রচারের হাতিয়ার করিয়া তুলিবার মধ্যে রাজ্যবাসীর প্রতি অসম্মান আছে কি না। সংবেদনশীল রাজনীতি যে মানুষের বিপন্নতার প্রতি অসচেতন থাকিতে পারে না, এই কথাটি আরও এক বার রাজনীতিকদের বলিবার সময় আসিয়াছে।