—প্রতীকী চিত্র।
বিদ্যালয়ে ছোটরা কী পড়বে, বরাবরই ঠিক করে এসেছেন বড়রা। পাঠ্যক্রম ঠিক করার জন্য আছে সিলেবাস কমিটি; কী ভাবে পাঠ্য বিষয়গুলি পড়ানো হবে, স্কুলপড়ুয়াদের কেমন করে দেওয়া হবে বইয়ের বাইরে চরিত্রগঠন ও নীতিশিক্ষার পাঠ, তারও পরিকল্পনা করেন শিক্ষা প্রশাসকেরা— ‘স্টেট কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক’ (এসসিএফ) তৈরি করে। প্রস্তাবিত সেই এসসিএফ নিয়েই সম্প্রতি শোরগোল উঠল মহারাষ্ট্রের শিক্ষামহলে। অভিযোগ, জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসরণে ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম’-এর প্রয়োগ করতে গিয়ে রাজ্যের শিক্ষা দফতর তথা সরকার ছেলেমেয়েদের যা শেখাতে চাইছে তাতে আগাগোড়া ধর্মের গন্ধ। পড়ুয়াদের স্মৃতিশক্তির অভ্যাস বাড়াতে সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে গীতা ও সমর্থ রামদাস স্বামীর শ্লোক আবৃত্তি, মূল্যবোধের পাঠ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত হয়েছে মনুস্মৃতি। বলা হয়েছে— অঙ্কের ক্লাসে ত্রিকোণমিতি শিখতে পড়া যেতে পারে ভাস্করাচার্য, এ ছাড়াও বিজ্ঞান প্রসঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় প্রযুক্তি, সুশ্রুত-চরকের চিকিৎসাবিদ্যা, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারণা দিতে বৈদিক ব্যাপারস্যাপার— অধিকন্তু ন দোষায়।
এই সবই প্রস্তাবিত, চূড়ান্ত নয়। মহারাষ্ট্রের অনেক শিক্ষাবিদ প্রতিবাদ করেছেন, করারই কথা— কারণ এই পরিকল্পনা একপেশে, একধর্মী। শিক্ষাক্ষেত্রে গৈরিকীকরণের অভিযোগ বিজেপির গত দশ বছরের শাসনামলে বহু বার উঠেছে, তা সে আইআইটির মতো উচ্চমানের প্রযুক্তিশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গরু ও গোমূত্র নিয়ে গবেষণা বা আলোচনা, ডাক্তারির সিলেবাসে আয়ুর্বেদ-সহ প্রাচীন ভারতীয় বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতির অন্তর্ভুক্তির চেষ্টাই হোক, কিংবা স্কুলশিক্ষায় মোগল ইতিহাস থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ মুছে ফেলাই হোক। শিক্ষামহল থেকে সরব প্রতিবাদ হয়েছে তখনও। আশ্চর্যের কথা এটাই, বিজেপি ও তার সঙ্গী দলগুলি কখনওই এই পন্থা থেকে সরে আসছে না, বরং এক-একটি রাজ্যে ঘুরেফিরে স্কুলশিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় নিয়ে আসছে এমন সব বিষয় যা মুখ ফিরিয়ে আছে পিছন দিকে, অতিপ্রাচীন ভারতের দিকে, একুশ শতক ছাড়িয়ে ভবিষ্যৎ ভারতের দিকে নয়— বিশ্ব অভিমুখে তো কখনওই নয়। তাই শিক্ষকেরা যখন বলছেন ভারতীয় সংবিধান তো সবচেয়ে বেশি ‘ভারতীয়’, কেন তার অনুস্যূত ধারণা ও সেই সঙ্গে আধুনিক বিশ্বশিক্ষা পড়ানো হবে না ভবিষ্যতের নাগরিককে— শিক্ষা প্রশাসন তথা সরকারের তরফে থাকছে আশ্চর্য নীরবতা।
কারণটি স্পষ্ট: ওতে কেন্দ্রের রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি হবে না। ভারতে রাজনীতির বয়ানে ও সমাজমনে যে ধর্মীয় বিদ্বেষ চারিয়ে দেওয়া গিয়েছে এরই মধ্যে, সেই বৃহৎ পরিকল্পনারই অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল স্কুলশিক্ষা। বুঝে ওঠার বয়স হওয়ার আগেই ছোট ছেলেমেয়েদের দিয়ে উপরোক্ত পাঠগুলি গিলিয়ে নেওয়া গেলে পোয়াবারো, অজানতেই তারা হয়ে উঠবে ‘প্রাচীন’পন্থী, মনে করবে এ-ই প্রকৃত দেশপ্রেম। মহারাষ্ট্রের মতো জাতি গোষ্ঠী ভাষা ধর্মের বৈচিত্রে ভরা রাজ্যে ‘ভারতীয়’ শিক্ষার নামে একবগ্গা সংখ্যাগুরুর ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সহজ, সরকারে ‘নিজের লোক’ বা জোট থাকায়। বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলির তাই এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা, নিরন্তর প্রতিবাদে কেন্দ্রের এই দুরভিসন্ধি বানচাল করার। ভারতের শিক্ষা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কোনও সঙ্কীর্ণ ‘এক’-এর নয়, বহু ও বহুত্বের শিক্ষা, এ কথা ভুললে চলবে না।