পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধের জন্য নহে, যুদ্ধ রোধ করিবার জন্য— এই ধারণাটি দীর্ঘকাল যাবৎ স্বতঃসিদ্ধ বলিয়াই গণ্য হইত। ঠান্ডা লড়াইয়ের সমগ্র আয়োজনটিই এই ধারণার উপর দাঁড়াইয়া ছিল, তাহার অবসানের পরবর্তী তিন দশকেও মোটের উপর সেই ট্র্যাডিশনই চলিয়াছে। নূতন নূতন ভৌগোলিক পরিধিতে পারমাণবিক অস্ত্রের স্বীকৃত অথবা প্রচ্ছন্ন প্রসার ঘটিয়াছে, তাহা লইয়া বিস্তর কূটনৈতিক সমস্যাও তৈয়ারি হইয়াছে, কিন্তু সেই অস্ত্র সত্যই ব্যবহার করা হইবে— এমন আশঙ্কা ১৯৬২ সালে ‘কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সঙ্কট’ কাটিয়া যাইবার পরে বিশেষ দেখা যায় নাই। এই পরিপ্রেক্ষিতেই রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাম্প্রতিক নির্দেশিকাটির তাৎপর্য অভূতপূর্ব। তিনি পারমাণবিক প্রতিরোধের ব্যবস্থাটিকে অতিরিক্ত সতর্কতার স্তরে প্রস্তুত করিবার জন্য দেশের প্রতিরক্ষা কর্তাদের নির্দেশ দিয়াছেন। সামরিক পরিভাষার জটিলতা সরাইয়া রাখিলে এই আদেশের সরল অর্থ: প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের জন্য আরও বেশি তৈয়ারি থাকিতে হইবে।
ইহার অর্থ এমন নহে যে, পুতিন অতঃপর পরমাণু যুদ্ধ শুরু করিতে চলিয়াছেন। স্পষ্টতই, এই নির্দেশের প্রধান লক্ষ্য: ভীতি প্রদর্শন। এমন ভয় দেখাইবার প্রয়োজন কেন হইতেছে, তাহাও সহজবোধ্য। যে দ্রুত এবং সহজ সাফল্যের হিসাব কষিয়া তিনি ইউক্রেন আক্রমণ করিয়াছিলেন, তাহা ভুল প্রমাণিত হইয়াছে, প্রতিবেশী দেশটি এখনও নতিস্বীকার করে নাই, রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতিও অপ্রত্যাশিত রকমের বেশি। তাহার পাশাপাশি, পশ্চিম দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞার চাপও বাড়িতেছে, বিশেষত আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে রাশিয়ার উপর বিধিনিষেধ গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করিতেছে। দুনিয়ার হাটে উত্তরোত্তর ‘অচ্ছুত’ হইবার পাশাপাশি স্বদেশেও অসন্তোষ বাড়িতেছে। স্বভাবতই পুতিন কিঞ্চিৎ বিপাকে। দৃশ্যত, এই চাপ সামলাইবার তাগিদেই তিনি ‘পরমাণু বোমা তৈয়ারি করিবার’ হুকুম দিয়া প্রতিপক্ষের উপর পাল্টা চাপ সৃষ্টি করিতে তৎপর হইয়াছেন। লক্ষণীয়, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে প্রথম আলোচনা শুরু করিবার নির্ধারিত সময়ের দুই দিন পূর্বে তিনি এই নির্দেশ জারি করিয়াছেন— দর কষাকষিতে আপন ক্ষমতা বাড়াইয়া লইবার মতলবটি নিতান্ত সুস্পষ্ট। অতএব মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ভয় দেখানোই প্রধান উদ্দেশ্য, সত্য সত্যই পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের সম্ভাবনা কম।
কিন্তু ইহাতে নিশ্চিন্ত বোধ করিবার উপায় নাই। প্রথমত, এই ধরনের ভীতি প্রদর্শনের ফল শেষ অবধি হিসাবের গণ্ডিতে সীমিত না থাকিতে পারে। বিশেষত, যখন সেই হুমকি দেওয়া হইতেছে ঘোরতর যুদ্ধের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ সম্পর্কে রাশিয়ার ঘোষিত অবস্থান ২০২০ সালে পরিবর্তিত হইয়াছে; তাহার পূর্বে মস্কোর নীতি ছিল: রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হইলে তাহারা ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করিতে পারে, কিন্তু পরিবর্তিত নীতি অনুসারে, যুদ্ধপরিস্থিতি যাহাতে নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া না যায়, তাহা নিশ্চিত করিবার জন্য রাশিয়ার রাষ্ট্র প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করিতে পারে। ব্যাধি কমাইবার জন্য আগে ব্যাধি বাড়াইবার ‘চিকিৎসা-বিধি’র কথা শোনা যায়, কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র লইয়া এমন বিধি বাস্তবিকই ভয়ঙ্কর। তৃতীয়ত এবং সর্বোপরি, সমস্ত হিসাবনিকাশ যে ধরনের সুস্থিত রাষ্ট্রের মাপকাঠিতে তৈয়ারি হয়, রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র ও তাহার প্রধান যন্ত্রীর উপর তেমন সুস্থিতির ভরসা কতখানি করা চলে? ইহা নিছক ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যক্তিগত অহংসর্বস্বতা বা অনুভূতিহীনতার প্রশ্ন নহে, রুশ রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং তাহার ধারক রাজনীতির বিভিন্ন স্তরেই বিস্তর সঙ্কট। এই পরিপ্রেক্ষিতেই পুরাতন প্রশ্নটি নূতন করিয়া বৃহৎ আকার ধারণ করিতেছে: পারমাণবিক অস্ত্রের বৈভব কি অতঃপর দুনিয়াকে ধ্বংসের পথই দেখাইবে? কেবল সময়ের অপেক্ষা?