গর্বের মাসটি চলে গেল। বিশ্ব জুড়ে জুন মাসটি ‘প্রাইড মান্থ’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে বেশ কিছু বছর— মানুষের যৌন পরিচয়ের বৈচিত্র স্বীকার ও তা উদ্যাপনের গর্ব, বহিরঙ্গে ‘এলজিবিটিআইকিউএ+’ গোষ্ঠীর উদ্যাপন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিশ্বের মানুষের যৌন পছন্দের অধিকারের নিশ্চয়তার উদ্যাপন। তারই প্রতীক রামধনু: তার অনেকগুলি রং আসলে মানুষের যৌন পরিচয়ের বিবিধতার সূচক; প্রতিটি রং একক ভাবে সুন্দর আবার একত্রে মিলেও— সেই বার্তাই নিহিত তার মধ্যে। জুন মাসে তাই কলকাতাও সেজে উঠেছিল রামধনুর রঙে— সাজপোশাকে, কফির কাপে, আইসক্রিমে, অ্যাপ-ক্যাবের লোগোয়, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে চলচ্চিত্র নির্বাচনে, রেস্তরাঁ বা সালোঁর অন্দরসজ্জা থেকে খাদ্য বা পরিষেবা-সূচিতেও। হয়েছে অনুষ্ঠান, আলোচনা, বিতর্কসভা; নাগরিকরা বুঝতে চেষ্টা করেছেন কেন এই গর্ব, কী এই উদ্যাপনের অর্থ। মানুষের অধিকারের পরিসর নিয়ে গর্ব করার মতো কারণ বা অগ্রগতি কলকাতায় সাম্প্রতিক কালে খুব বেশি ঘটেনি, ‘প্রাইড মান্থ’ নিয়ে নাগরিক সংলাপ সেই নিরিখে বিরল ও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বলেই মনে হয়।
কলকাতাবাসীর গর্বের সত্যিই কারণ আছে। ১৯৯৯ সালে এই শহরে ‘ফ্রেন্ডশিপ ওয়াক’ হয়েছিল, আজকের ‘প্রাইড ওয়াক’-এর যা পূর্বসূরি। এলজিবিটি-গোষ্ঠীর মানুষেরা এই শহরের রাজপথে হেঁটেছিলেন। তাঁদের হাতের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘ডোন্ট থিঙ্ক স্ট্রেট, থিঙ্ক পিপল’। এই পদযাত্রাও এক বিশেষ স্মরণ: ১৯৬৯ সালের জুন শেষে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে সমপ্রেমী মানুষদের পছন্দের এক পানশালায় পুলিশি ধরপাকড় ও অত্যাচারের প্রতিবাদে ক্রমে বিশ্বের নানা দেশে ও শহরে বছর বছর এমন পদযাত্রা হতে থাকে। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতে এ-হেন পদযাত্রার ঘটনা ছিল অভাবিত, বিশেষত তার আগের বছরেই ফায়ার ছবির মুক্তি ও প্রদর্শন নিয়ে মুম্বই দিল্লি পুণে সুরাত-সহ নানা শহরে সঙ্কীর্ণমনা ও সমপ্রেমদ্বেষী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর তাণ্ডব-স্মৃতি তখনও সমাজমনে দগদগে। কলকাতা ছিল বিরল ব্যতিক্রম, এমনকি এ শহরেও ছবি চলাকালীন কিছু লোক গন্ডগোল বাধানোর চেষ্টা করলে প্রতিবাদ করেছিলেন প্রেক্ষাগৃহের কর্মী ও দর্শকেরাই। মানুষের অধিকারের পক্ষে লড়াইয়ে পাশে থাকার নাগরিক মন কলকাতার ছিল বলেই ১৯৯৯-এর ২ জুলাই ‘বন্ধুতার পদযাত্রা’ হয়েছিল এ শহরেই, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম! তার পর থেকে গত দু’দশকে ‘প্রাইড ওয়াক’ তথা সমপ্রেম তথা মানুষের যৌন পরিচয়ের বিস্তৃত পরিসর নিয়ে মহানগরের সচেতনতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। সামাজিক দৃশ্যমানতাই তার প্রমাণ। ২০২২-এর কলকাতায় কর্পোরেট কর্মক্ষেত্র থেকে শিক্ষা, বিনোদন, সাহিত্যে অন্যতর যৌন-পরিচিতির বোধ ও সহনশীলতা ঊর্ধ্বমুখী।
কিন্তু সামাজিক দৃশ্যমানতা মানেই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নয়। সে দিক থেকে দেখলে কলকাতা তথা সারা রাজ্যেরই অনেক পথ চলা বাকি। নারী-পুরুষ লিঙ্গ ও যৌন পরিচিতি বিষয়ে যে একরৈখিক নির্মাণ সমাজ মানুষের উপর আরোপ করেছে, সেই চেনা ছকের বাইরে আলাদা যা কিছুই তার কাছে ‘অন্য রকম’। এই ভিন্নতা তার দীর্ঘলালিত সংস্কারে ঘা দেয়, নতুন করে ভাবাতে চায় বলেই সমাজ তার বিরোধিতা করে, তাকে ব্যঙ্গবিদ্রুপে ভরিয়ে দেয়, তার উপরে হয়ে ওঠে খড়্গহস্ত। সে বুঝতে চায় না লিঙ্গ ও যৌনতার বোধ স্রেফ শরীরসর্বস্ব নয়, পুরুষের লিঙ্গ-পরিচিতি শরীরে ধারণ করেও কারও মানসিক লিঙ্গ ও যৌনচেতনা হতেই পারে নারীর, বা উল্টোটা, বা দু’টিই, অথবা নারী-পুরুষের ছকের বাইরে কোনও বোধ, কিংবা এই দুই লৈঙ্গিক অবস্থানকে সতত প্রশ্ন করে আত্মপরিচয়ের অন্বেষণও হতেই পারে কারও যৌন অবস্থান। এই সবই, এবং অস্তিত্বের আরও বহু স্তর ধরা আছে ‘এলজিবিটিআইকিউএ+’ অক্ষরসমষ্টিতে, এমনকি ক্ষুদ্র যোগচিহ্নটিও সেই বহুত্বেরই ব্যাপ্তিনির্দেশক। আজ কলকাতার চলচ্চিত্রকার বা ঔপন্যাসিকের শিল্পে সমপ্রেম বা ছক-ভাঙা যৌনতার প্রকাশ দেখে আর ভিনগ্রহী বা অস্বাভাবিক মনে হয় না, কিন্তু তা সমাজের বৃহদংশ বা সাধারণ্যকে কতটা ভাবাতে পারছে, তাতেই তার সার্থকতা। রামধনুরঙা পতাকা যেন উড়বার বাতাসটুকু পায়, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব এই শহরের। সব নাগরিক যে দিন সেই দায়বদ্ধতা থেকে সাগ্রহে রাজপথে নামবেন, সেই পদযাত্রাই হবে আসল গর্বের পথ হাঁটা।