Homosexuality

ভালবাসা যথেষ্ট নয়

গত চার বছরে এমন নানা ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ‘অ-স্বাভাবিক’ যৌন প্রবণতার দায়ে নাগরিকরা লাঞ্ছিত, অপদস্থ, অত্যাচারিত হয়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৪০
Share:

ভালবাসা যথেষ্ট নয়।

ভালবাসা থাকলেই সব কিছু করে ফেলা সম্ভব— কালজয়ী কথাটি গত শতকের ষাটের দশকে বিটলস-এর গানে জগৎ মাতিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে জন লেনন-এর লেখা ‘অল ইউ নিড ইজ লাভ’ অর্ধ শতাব্দী অতিক্রম করেও ভরসা দেয়, শক্তি দেয়। আবার, প্রশ্নও তোলে। অভিজ্ঞতাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করে চিন্তাশীল মানুষ সংশয় জানান: সত্যই কি ভালবাসা এমন শক্তিমান? বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় সংশয় জানাননি, সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন: “আমি তাঁদের (বিটলস-এর) সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলতে চাই— আমাদের বোধ হয় ভালবাসার সঙ্গে ঈষৎ অন্য কিছুও দরকার।” ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সমকামিতার প্রশ্নে এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল। তার আগে, এ দেশের বিচারব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরে সমকামিতাকে কার্যত অপরাধ বলে গণ্য করেছে। ওই রায় অন্তত আইনের পরিসরে সেই অন্যায়ের অবসান ঘটায়। এলজিবিটিকিউপ্লাস বা সংক্ষেপে এলজিবিটি নামে অভিহিত সমকামী তথা বিভিন্ন ধরনের যৌন-পরিচিতি সম্পন্ন মানুষের স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলনে প্রেরণা ও শক্তি সরবরাহ করেছে সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত। সেই মামলায় অন্যতম বিচারক ছিলেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। চার বছর পরে এলজিবিটি আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি ‘যুগান্তকারী’ রায়ের গৌরব কীর্তনে সন্তুষ্ট থাকতে চাননি, সাফ সাফ জানিয়েছেন: সমকামিতাকে অপরাধের কলঙ্ক থেকে মুক্তি দিলেই সমতা আসবে না, কাঠামো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দরকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, বিভিন্ন ধরনের যৌনাচরণের সমান অধিকার ও মর্যাদাকে প্রসারিত করতে হবে ‘জীবনের সমস্ত অঙ্গনে— গৃহে, কর্মক্ষেত্রে, জনপরিসরে’। এই সূত্রেই তাঁর বক্তব্য, ভালবাসা যথেষ্ট নয়।

Advertisement

রায়ের পরেও ভারতে যৌনাচরণের স্বাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। গত চার বছরে এমন নানা ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ‘অ-স্বাভাবিক’ যৌন প্রবণতার দায়ে নাগরিকরা লাঞ্ছিত, অপদস্থ, অত্যাচারিত হয়েছেন। এবং, বলা বাহুল্য, এমন নিপীড়নের অধিকাংশই সংবাদ হিসাবে প্রকাশিত হয়নি। সুতরাং, বিচারপতির ক্ষোভ বা অতৃপ্তি স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি ভালবাসার কথা আনলেন কেন? আইন-আদালত দিয়ে সামাজিক সমস্যা পুরোপুরি মেটে না, সমাজ বদলাতে হয়— কেন এই পরিচিত কথাটি বলেই নিবৃত্ত হলেন না? এখানেই তাঁর মন্তব্যের গভীর তাৎপর্য। সমাজ বদলানোর প্রশ্নে অনেক সময়েই ভালবাসার উপর জোর দেওয়া হয়— বিশেষ করে যাঁরা কোনও না কোনও দিক থেকে সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক, সংখ্যাগরিষ্ঠ বা ‘মূলধারা’র সঙ্গে যাঁদের মানসিকতা এবং আচরণ মেলে না, সমাজকে তাঁদের প্রতি প্রীতি ও সহিষ্ণুতার উপদেশ দেওয়া হয়। সদুপদেশ, অবশ্যই। যে ‘অন্য রকম’, তার প্রতি সহিষ্ণু হওয়া যথার্থ সভ্যতার আবশ্যিক শর্ত, তাকে ভালবাসা তো খুব বড় এবং খুব শক্তিশালী গুণ।

কিন্তু প্রশ্ন হল, সমাজের মূলধারা দুর্বল ও প্রান্তিক ধারাগুলিকে ভালবেসে স্বীকার করবে এবং আপন অভিরুচি অনুসারে চলতে দেবে, তাদের দমন করবে না, গ্রাস করবে না, তবে তারা সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে— এমন নীতি কি একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী? প্রান্তিকের স্বাধিকার কেন মূলধারার হৃদয়বৃত্তির উপর নির্ভর করবে? সমাজ তাকে ভালবাসতে পারুক বা না পারুক, তার নিজের মতো বেঁচে থাকার স্বাধীনতা অলঙ্ঘনীয়। এই দেশের সমাজ আজও সচরাচর স্বাধিকারের এই মর্যাদা দেয় না, দিতে শেখেনি। বিশেষত যৌন প্রবণতা বা পছন্দের মতো বিষয়ে স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের গতানুগতিক এবং অযৌক্তিক ধারণাগুলি মান্ধাতার আমলেই পড়ে আছে, সেই ধারণার কাছে ‘অন্য রকম’ মানেই অস্বাভাবিক, অতএব তাকে স্বাভাবিক করে তুলতে হবে, ‘সকলের মতো’ অর্থাৎ সামাজিক অনুশাসনের মাপকাঠিতে যথাযথ হয়ে উঠতে হবে, নচেৎ সমাজ তাকে একঘরে করবে, বিদ্রুপ করবে, অনেক সময়েই পীড়ন করবে, সেই পীড়ন ভয়ঙ্কর অত্যাচারের রূপও নিতে পারে। শুধু ভালবাসার গান শুনিয়ে এই অন্যায়ের যথেষ্ট প্রত্যুত্তর দেওয়া যায় না। ‘স্বাভাবিক’-এর তন্ত্রধারীদের মুখের উপর বলতে হবে: প্রত্যেকটি নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন যাপনের স্বাধীনতা তাঁর প্রাথমিক অধিকার, সেই অধিকারকে কেবল মেনে নেওয়া নয়, তাকে সম্মান করাই গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত। বিচারপতি চন্দ্রচূড়কে ধন্যবাদ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement