Vandana Katariya

গভীর অসুখ

যে মানসিকতা জাতি-বর্ণের উঁচু-নিচু ভেদ শুধু বিশ্বাসই করে না, সামাজিক যাপনে তাহা আচরণ ও রীতিমতো উদ্‌যাপন করে, তাহার সমস্যার সমাধান কোথায়?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২১ ০৫:২৪
Share:

হরিদ্বারের গ্রামে বন্দনা কাটারিয়ার বাড়ির সম্মুখে উচ্চবর্ণের কয়েক জন প্রতিবেশী বাজি-পটকা ফাটাইয়া ব্যঙ্গনৃত্য করিল। চিৎকার করিয়া বলিল: ভারতীয় মহিলা হকি দলে এত দলিত খেলোয়াড় বলিয়াই দল সেমিফাইনালে হারিয়াছে; শুধু হকি নহে, সব খেলা হইতে দলিত খেলোয়াড়দের দূর করিয়া দেওয়া উচিত। স্বাধীনতার ৭৫ বৎসরের সূচনালগ্নে গর্বিত ভারতের এই হইল ছবি। তাহার মানসপটে লিখা জাতিবিদ্বেষ, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদের প্রতি পুঞ্জ পুঞ্জ ঘৃণা, অসম্মান। ইহাকে বিক্ষিপ্ত ঘটনা, পরিস্থিতির উত্তেজনার তাৎক্ষণিক বহিঃপ্রকাশ বলিয়া পার পাওয়া যাইবে না, কারণ উত্তরাখণ্ড হইতে তামিলনাড়ু, উত্তর হইতে দক্ষিণ— সমগ্র ভারতে জাতি ও বর্ণবিদ্বেষের খবর নিয়মিত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। হাথরসের ভয়ঙ্কর ঘটনার স্মৃতি এখনও মুছিয়া যায় নাই, দিল্লিতে কয়েক দিন আগেই নয় বৎসরের এক দলিত বালিকাকে ধর্ষণ ও খুন করিয়া দেহ পুড়াইয়া দিয়াছে উচ্চবর্ণের দুষ্কৃতীরা। তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লি জেলায় মাথা তুলিয়াছে নয় ফুট উঁচু প্রাচীর, দলিত জনবসতি হইতে উঁচু জাতের লোকেদের খেতখামার আড়াল করিতে। সেমিফাইনালে হারিবার কয়েক দিন পূর্বেই বন্দনা ইতিহাস গড়িয়াছেন— প্রথম ভারতীয় মহিলা হকি খেলোয়াড় হিসাবে অলিম্পিকের কোনও ম্যাচে হ্যাটট্রিক করিবার ইতিহাস। তাহাতে দলিত হইবার ‘অপরাধ’ মুছে নাই। সাত দশক অতিক্রান্ত স্বাধীন ভারতে ইচ্ছা করিলেই তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে অপমান ও হেনস্থা, দলিত নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করা যায়— সেই তুলনায় বাড়ির সম্মুখে কদর্য নাচানাচি ও হুমকি তো কিছুই নহে।

Advertisement

অভিযুক্তরা ধরা পড়িয়াছে; হয়তো শাস্তিও পাইবে। কিন্তু তাহাতেই কি সার্বিক নিষ্পত্তি? যে মানসিকতা জাতি-বর্ণের উঁচু-নিচু ভেদ শুধু বিশ্বাসই করে না, সামাজিক যাপনে তাহা আচরণ ও রীতিমতো উদ্‌যাপন করে, তাহার সমস্যার সমাধান কোথায়? যে সমাজ এক দিকে জাতীয় দলের খেলোয়াড়ের সংগ্রামকে তুমুল বাহবা দেয়, অন্য দিকে ব্যর্থতার দায় চাপায় খেলোয়াড়ের জাতি-পরিচিতির উপর, সেই সমাজের গভীর অসুখ কী ভাবে সারিবে? বন্দনা আজ সুকীর্তি বলিয়া তাঁহার বাড়ির ঘটনা লইয়া হইচই পড়িয়াছে; অন্যথায়, এই দেশে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের সহিত ঘটিয়া যাওয়া অপরাধ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রকাশ্যই রহিয়া যায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য, দলিত শিশু ও মহিলাদের বিরুদ্ধে ২০১৯-এ ঘটা মোট অপরাধের মধ্যে যথাক্রমে মাত্র ৩৩.৮ ও ৩১.৭ শতাংশ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হইয়াছে। সেই বৎসর দলিত শিশু ও নারীদের সঙ্গে ঘটা অপরাধের মামলার যথাক্রমে ৮৯.৭ ও ৯১.৮ শতাংশ বৎসরের শেষেও বিচারের অপেক্ষাতেই থাকিয়া গিয়াছে। দলিতদের বিরুদ্ধে ঘটনা অন্যায়ের অতি সামান্য অংশই যে শেষ অবধি থানা বা আদালতে পৌঁছায়, তাহাও ভুলিলে চলিবে না। আইনের আড়ালে নিম্নবর্ণের মানুষের সহিত ঘটিয়া যায় যে দুষ্কৃতি, তাহার বিচার কে করিবে? ইউরো কাপ ফাইনালে হারিবার পর, বর্ণবিদ্বেষের শিকার ইংল্যান্ড জাতীয় ফুটবল দলের তিন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের সমর্থনে দেশের সব ক্লাব, ক্রীড়া কর্তৃপক্ষ, সরকার, জনতাও সরব হইয়াছিল। ভারতে বন্দনার ঘটনায় দুই-একটি প্রতিবাদী স্বর, বাকি সমাজ-সংসারে অখণ্ড নীরবতা। রাজনীতির নির্লজ্জ সুবিধাবাদের বিষ সমাজমনে চারাইয়া গিয়াছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement