উদ্বাস্তু বা শরণার্থী, জোর করে স্বভূমিচ্যুত করা হয়েছে এমন গোষ্ঠী, কিংবা ‘দেশহীন’ মানুষকে রক্ষা, তাঁদের স্বদেশে ফেরা বা অন্য এক দেশে নতুন জীবন শুরু করায় সাহায্য করে রাষ্ট্রপুঞ্জের যে এজেন্সিটি, সেই ‘ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস’-এর ওয়েবসাইট দেখলে চোখে পড়বে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের পরিসংখ্যান— এ বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে স্বদেশের সীমান্ত পেরিয়েছেন ১ কোটি ৩ লক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশি ইউক্রেনীয়; ইউরোপের নানা দেশে কোনও না কোনও ভাবে নথিভুক্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তি ইউক্রেনীয়ের সংখ্যা ৬৩ লক্ষের কিছু বেশি; নানা ‘সহমর্মী’ দেশে সাময়িক নিরাপত্তা বা সমধর্মী জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিষেবা পেতে নথিভুক্ত হয়েছেন এমন ইউক্রেনীয়ের সংখ্যা ৩৮ লক্ষেরও কম। প্রতি শুক্রবার এই ওয়েবসাইটের তথ্য আপডেট করা হয়, এই সবই অগস্ট-শুরুর তথ্য। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে বড় শরণার্থী-সঙ্কট দেখছে বিশ্ব।
পরিসংখ্যান সবটুকু বলে না। অন্তত, তৎক্ষণাৎ বলে না। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পর প্রায় অর্ধেক বছর কেটে গেলেও তাই রাষ্ট্রপুঞ্জ ইউনিসেফ বা অন্য মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠনগুলি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন— ইউক্রেনীয় নারী শরণার্থী ও উদ্বাস্তু শিশুদের নিয়ে। অতীতে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হত, সাধারণ মানুষ হত দুর্গত। রাজতন্ত্র পেরিয়ে গণতন্ত্র এলেও যুদ্ধ থামেনি, সাধারণ্যের দুর্গতিও— আর ইতিহাস থেকে সমাজবিজ্ঞান সাক্ষী, যুদ্ধের প্রত্যক্ষ দহন ও পরোক্ষ আঁচ দুই-ই সইতে হয় নারী ও তাঁদের শরীরলগ্ন শিশুদের। ইউক্রেনের উদ্বাস্তুদের ৯০ শতাংশই নারী ও শিশু, তা হওয়ারই কথা— আঠারো থেকে ষাট বছর বয়সি ইউক্রেনীয় পুরুষদের স্বদেশত্যাগ নিষিদ্ধ, যুদ্ধ বড় বালাই। ইউনিসেফ-এর তথ্য বলছে, ইউক্রেনের কুড়ি লক্ষ শিশু দেশছাড়া হয়েছে গত মার্চ-অন্তেই— দশ লক্ষেরও বেশি পৌঁছেছে পোল্যান্ডে, আরও হাজার হাজার রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, চেক প্রজাতন্ত্রে। এহ বাহ্য, দেশের ভিতরে স্থানচ্যুত হয়েছে ২৫ লক্ষ ইউক্রেনীয় শিশু, যুদ্ধধ্বস্ত দেশে গুঁড়িয়ে গিয়েছে শৈশব। তেলের বাজার, বিশ্ব-অর্থনীতিতে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রকোপ ও প্রভাব নিয়ে যত কথা, অপ্রিয় হলেও সত্য— তার কথঞ্চিৎও হয়নি ইউক্রেনীয় শিশুদের নিয়ে। সময়ে যুদ্ধও সয়ে যায়, লক্ষ লক্ষ শিশুর পরিবারবিচ্ছিন্নতাকে যুদ্ধেরই উপজাত ধরে নিয়ে, মুখ ফিরিয়ে এগিয়ে গিয়েছে পৃথিবী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সমাজ-ইতিহাস, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দেখলেই চোখে পড়বে, বিশ্বযুদ্ধের সময়ের শিশুরা হৃত স্বদেশ ও শৈশবের মূল্য চুকিয়েছে দীর্ঘ কাল, এমনকি একাধিক প্রজন্ম ধরে। সেই বিষাদগাথায় ইহুদি শিশুর সঙ্গে হিরোশিমা-নাগাসাকির শিশুতে তফাত ছিল না। ব্যতিক্রম নয় আজকের ইউক্রেনীয় শিশুরাও। ইউনিসেফ-সহ বহু সংস্থা বলছে, সমরাঙ্গনের সমান্তরালেই আরও বড় একটা যুদ্ধ চলছে— অত্যাচার, পাচার, শোষণ, বিভেদের হাত থেকে ইউক্রেনীয় শিশুদের বাঁচানোর যুদ্ধ; মাথার উপর একটা ছাদ, থালায় একটু খাবার, ইস্কুলের শিক্ষা জোগানোর সংগ্রাম। চোখের সামনে ঘটা যুদ্ধের পক্ষাবলম্বন বা বিরোধ সহজ; চোখের বাইরে ঘটছে যা, তাকে দেখতে চাই মানবিকতা ও সমানুভূতির অন্তর্দৃষ্টি। বিশ্ব আজ সেই দরদি চোখটি না মেললে ভবিষ্যতের ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না।