প্রতীকী ছবি।
রন্ধনকালে প্রেশার কুকারের অভ্যন্তরে অধিক বাষ্প জমিয়া উঠিলে তাহা সশব্দে নিষ্ক্রান্ত হয়। বেকারত্ব লইয়া রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কথাগুলি যেন তেমনই শুনাইল দেশবাসীর কানে। ভারতে বেকারত্বের প্রকোপ সকল দুঃস্বপ্নকে ছাড়াইয়াছে। শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থানহীনতা উদ্বেগজনক, গ্রামেও তাহা অতীতের তুলনায় অধিক। অতিমারির তীব্রতা কমিতেই বহু মানুষ গ্রাম ছাড়িয়া কাজের খোঁজে ফের শহরে পৌঁছাইয়াছেন, কিন্তু কাজ মিলে নাই। সেই বাস্তবেরই প্রতিফলন ঘটিয়াছে বেকারত্বের এই পরিসংখ্যানে। কর্মহীনতা অতিমারির পূর্বেই বাড়িতেছিল, অতঃপর লকডাউনে বিপুল সংখ্যক ছাঁটাই হইয়াছে, তাহার তুলনায় নূতন কাজও তৈরি হয় নাই। ফলে বেকারত্বের জ্বালায় কেবল সাধারণ নাগরিক দগ্ধ হইতেছেন এমন নহে, তাহার আঁচ লাগিয়াছে রাজনীতিতেও। একটি সরকারি সমীক্ষা অনুসারে, উত্তরপ্রদেশে পনেরো হইতে চব্বিশ বৎসর বয়সিদের মধ্যে কর্মহীনতা প্রায় আঠারো শতাংশ, যদিও স্বীকার করিতেই হইবে যে, ভোটের ফলে তাহার আঁচ পড়ে নাই। কাজের মান লইয়াও প্রশ্ন রহিয়াছে— যেমন, উত্তরপ্রদেশে কর্মনিযুক্ত ব্যক্তিদের মাত্র পনেরো শতাংশ নিয়মিত চাকুরিতে নিযুক্ত, বাকি সকলেই অস্থায়ী কাজ, অথবা অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোনও কাজে যুক্ত। লকডাউনে বহু ছোট ব্যবসায়ী তাঁহাদের ব্যবসা বন্ধ করিতে বাধ্য হইয়াছেন, বিকল্প রোজগারের উপায়ও তাঁহারা খুঁজিয়া পান নাই। সরকারি চাকরির পরীক্ষার্থী ক্রমেই বাড়িয়াছে, কিন্তু কখনও প্রশ্ন ফাঁস হইয়া পরীক্ষা বাতিল হইয়াছে, কখনও চাকুরিপ্রার্থীদের উপর পুলিশের লাঠি চলিয়াছে। ভোটের ফলে তাহার প্রভাব পড়ে নাই বটে, কিন্তু নির্বাচনী জয়ের উল্লাসে যে তরুণ-তরুণীদের কর্মহীনতার ক্ষোভ চাপা পড়িবে না, তাহা স্পষ্ট। তাই নির্বাচনী জয়ের গৌরবের রেশ না মিলাইতে বেকারত্ব লইয়া সঙ্ঘ মুখ খুলিল। বিরোধী ঘায়েল হইয়াছে, এখন সমালোচনার লাঠি ঠুকিলে ক্ষতি নাই।
সঙ্ঘ কর্মসংস্থানের ‘ভারতীয় মডেল’ স্থাপনের সুপারিশ করিল। কথাটি নূতন নহে, পাশ্চাত্যের সংস্পর্শ বাঁচাইয়া ভারতীয় শিল্পোদ্যোগীদের দ্বারা ‘স্বদেশি’ শিল্পে প্রচুর কর্মসংস্থান করা হইবে— ইহাই সেই মডেল। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসিবার পরেই দলের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, অর্থাৎ ভারতে উৎপাদন শিল্পের বৃদ্ধির লক্ষ্য গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাহার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের উৎপাদন ক্ষেত্রে দশ কোটি কাজ তৈরি করা। তাহার কতটুকু হইয়াছে, প্রশ্ন করিতে নাগরিকেরই লজ্জা করিবে। এইটুকু বলিলেই চলে যে, উৎপাদন শিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ে নাই, কমিয়াছে। সঙ্ঘ শ্রমনিবিড় উৎপাদন ব্যবস্থার কথা বলিয়াছে। রাজনীতির বুলি হিসাবে কথাটির দাম থাকিতে পারে, অর্থনীতির মাপে নহে। যে উৎপাদন ব্যবস্থায় ভারতীয় পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার যোগ্যতা হারাইবে, তাহা কখনও গ্রহণযোগ্য পন্থা হইতে পারে না।
ক্ষমতায় আসিবার পূর্বে মোদী বৎসরে এক কোটি নূতন কাজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। তাহা পূরণ হইলে মাসে আট লক্ষেরও অধিক কাজ সৃষ্টি হইত। কিন্তু তথ্য বলিতেছে, ২০২০ অবধি মাসে পাঁচ লক্ষ কাজও তৈরি হয় নাই। অতিমারির পূর্বেই বেকারত্বের সমস্যা কঠিন হইয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী কখনও সেই ব্যর্থতাকে স্বীকার করেন নাই। কখনও শ্রমশক্তি সম্পর্কিত রিপোর্ট অপ্রকাশিত রাখিয়া, কখনও নূতন নিয়োগের বিচিত্র পরিসংখ্যান পেশ করিয়া কেন্দ্র কর্মসৃষ্টির নানা দাবি করিয়াছে। সেইগুলির অসারতা নানা অসরকারি এবং সরকারি সমীক্ষায় প্রমাণিত, অপুষ্টি-অশিক্ষার ক্রমবর্ধমান হারও তাহার সাক্ষী। সঙ্ঘ তাহাতে সিলমোহর দিল, লাভ বলিতে এই।