ঋষি সুনক। ছবি: রয়টার্স।
তিন মাসে তৃতীয় নতুন প্রধানমন্ত্রী। এমনিতেই ঐতিহাসিক ঘটনা। তার মধ্যেও ব্রিটেনের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতারোহণ অনেক দিক থেকেই অতিরিক্ত ঐতিহাসিক বটে। এই প্রথম সে দেশে কোনও অশ্বেতাঙ্গ মানুষ শীর্ষপদে আরোহণ করলেন। বিষয়টা সহজ নয়, আজও ব্রিটেনের সর্বত্র এক রকম বর্ণবিদ্বেষের চোরা স্রোত, অভিবাসন-বিরোধিতার পরিবেশ যাকে আরও প্রত্যক্ষগ্রাহ্য করে তুলছে। যে উইনস্টন চার্চিল সে দেশে রাষ্ট্রশক্তির অন্যতম আইকন, তিনিই হয়তো আজ বলতে পারতেন, ডারউইনের তত্ত্বে অশ্বেতাঙ্গরা নিম্ন গোত্রের মানুষ, তাদের এই পদে বসানো বুদ্ধির কাজ নয়। নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক আদ্যন্ত ব্রিটিশ এবং চূড়ান্ত এলিট হলেও ভারতীয় বংশোদ্ভূত, ফলত তাঁকে নিয়ে উপমহাদেশীয় ডায়াস্পোরায় বিস্তর উত্তেজনা। কিন্তু ব্রেক্সিট-বিশ্বাসী ব্রিটেনে কি বৈচিত্রের এই উদ্যাপন সহনীয়? এ দিকে দু’শো বছরের ইতিহাস বলছে, এত কম বয়সে সে দেশে কেউ প্রধানমন্ত্রী হননি। ৪২ বছর বয়সি সুনক ক্ষমতায় এলেন অর্থনীতির যখন সঙ্গিন দশা। এখন তাঁর সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ, নিজের পদটিতে স্থিত থেকে অর্থনীতিকে সামলানো, সরকার ও দেশকে সঙ্কটচূড়া থেকে নামিয়ে আনা।
উল্লসিত ভারতীয়দের জন্য একটি সতর্কবার্তা। ভারতীয় উত্তরাধিকার থাকলেও সুনক ভারতবন্ধু কি না বলা মুশকিল। কনজ়ারভেটিভ পার্টির ব্রেক্সিট-পন্থী গোষ্ঠীর অন্যতম কড়া মুখ সুনক, অভিবাসনের ক্ষেত্রেও কড়া অসহিষ্ণু মত তাঁর। অতীব বিত্তশালী পরিবারে জন্ম, এলিট স্কুল-কলেজে তাঁর পাঠ, আর্থিক ভাবেও দেশের সচ্ছলতম প্রধানমন্ত্রী তিনি। পূর্বসূরি প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আমলে যখন সুনক অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখনকার নীতিই বলে দেয়, আর্থিক বা বাণিজ্যিক দিক দিয়ে ভারতের মতো দেশের বিশেষ আশা থাকতে পারে না তাঁর কাছে। আয়কর থেকে শুরু করে ছাত্র অভিবাসন কিংবা স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সব ক্ষেত্রেই সে দেশের নিম্ন আয়-গোষ্ঠীর, অর্থাৎ অভিবাসী জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশের, স্বার্থবিরোধী নীতিতে তাঁর আস্থা। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্রিটেনের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েই তিনি ভারতের সঙ্গে চুক্তি করবেন, যেমন অন্য প্রধানমন্ত্রীরাও করে এসেছেন। দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা পরিষেবাজাত তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে। ব্রিটেন সেখানে অনেকটা ছাড় দেবে ভারতকে, এমন আশা এখনও নেই। সে দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা ও তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ভারতীয় পরিষেবার পথ প্রশস্ত করাও ভারতের দিক থেকে অন্যতম দাবি। সে দাবি মেটার আশাও খুব উজ্জ্বল নয়।
সুতরাং, অযথা উত্তেজিত না হয়ে বরং ভাবা যেতে পারে, ভারতের এই ঘটনা থেকে কিছু শেখার আছে কি না। ব্রিটেন দেশটি এই মুহূর্তে যথেষ্ট সঙ্কটগ্রস্ত, কিন্তু এক দিক দিয়ে গণতন্ত্রের দৌড়ে সে যে কতখানি অগ্রসর, আরও এক বার প্রমাণ হল। জাতি-ধর্ম-বর্ণের বাইরে গিয়ে ব্যক্তি কতখানি গুরুত্ব পেতে পারেন সে দেশে, প্রমাণ হল। বিপরীতে, ভারতীয় গণতন্ত্রের ছবিটি ক্লেশকর রকমের দুর্বল। অদূর কেন, সুদূর ভবিষ্যতেও কোনও মুসলমান প্রধানমন্ত্রী দিল্লি দরবারে পা রাখবেন, ভাবা কঠিন। বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দলে কত জন মুসলমান সদস্য, ভেবে লজ্জা পেতে হয়, যদিও সম্ভবত বর্তমান শাসক দল এই ঘটনায় লজ্জার স্থলে গৌরবই বোধ করেন। ব্রিটেনের রক্ষণশীল সমাজের মতামত যা-ই হোক না কেন, রাজনীতির তলে কিন্তু রক্ষণশীল কনজ়ারভেটিভ পার্টির পক্ষেই এই কৃতিত্ব সম্ভব হল। সুনক যেমন প্রধানমন্ত্রীই হোন না কেন, দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে তাঁর অধিষ্ঠানে সে দেশের বহুসংস্কৃতি-পরিবেশের জোরটিই উদ্ভাসিত হল। তাই সুনক-সংবাদে আত্মহারা না হয়ে এই অবকাশে ভারতীয় নাগরিক আত্ম-অনুসন্ধানে বসুন: কী তাঁরা চেয়েছিলেন, আর কী তাঁরা পেয়েছেন, সে হিসাব কষতে।