আর জি কর ধর্ষণ-হত্যা কাণ্ড একটি অপরাধ আর নেই, অপরাধের একটা ‘ক্যাটিগরি’ কিংবা ধারা হয়ে উঠেছে। শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে এক মহিলা-চিকিৎসক অভিযোগ করেছেন, হাসপাতালের সুপার তাঁকে হুমকি দিয়েছেন, ‘আর জি কর করে দেব।’ সুপার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে গত ৯ অগস্টের ঘটনার পরে এমন হুমকি এই প্রথম নয়। অক্টোবরে আর জি কর হাসপাতালের এক মহিলা চিকিৎসক, সেপ্টেম্বরে মালদহের চাঁচলে সরকারি হাসপাতালে কর্তব্যরত নার্স, একই হুমকি শুনেছেন রোগীর কাছ থেকে। হাসপাতালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র ‘আর জি কর’ হয়ে ওঠার উপক্রম হচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, ‘আর জি কর’ এ রাজ্যে হুমকির একটি লব্জ হয়ে উঠেছে। ‘অবাধ্য’ মেয়েদের কত দূর ক্ষতি কত সহজে করতে পারে পুরুষ, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিতে এখন ‘আর জি কর করে দেব’ বলাই যথেষ্ট। এক অন্ধকার সেমিনার রুমে ক্ষতবিক্ষত এক দেহ, এবং সেই বীভৎস মন্তাজের রূপকারদের প্রতি প্রশাসনের মনোভাব, এ দু’টি পশ্চিমবঙ্গের হুমকি সংস্কৃতি, ধর্ষণ সংস্কৃতিকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করার অনুমতি রাজ্য সরকার দিল না কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাকে, হুমকি সংস্কৃতিতে অভিযুক্ত ছাত্র ও ডাক্তারদের আর জি কর হাসপাতাল থেকে সাসপেন্ড করার বিরোধিতা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। অভীক দে ও বিরূপাক্ষ বিশ্বাস, শাসক-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত যে দুই চিকিৎসক আর জি কর কাণ্ডে জড়িত সন্দেহে, এবং নানা দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার জন্য রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল থেকে সাসপেন্ড হয়েছিলেন, তাঁরাও ফিরেছেন কাউন্সিলে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত হাসপাতালে ডিউটিরত মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ-হত্যার অভূতপূর্ব, জঘন্যতম অপরাধকে যেন লঘু করে তুলেছে। অপরাধীর গ্রেফতার ও শাস্তির প্রত্যাশাকে ক্ষমতার খেলায় হারজিতে পর্যবসিত করেছে শাসক দল।
ন্যায়বিচারের অধিকার প্রতিহত হলে জিত হয় কার? কোনও এক দুর্বৃত্তকে শাসন করায় রাজশক্তি যদি অনিচ্ছুক বা অপারগ হয়, তা হলে সব দুর্বৃত্তকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়। অভয়ার বিচার মিলবে না, প্রকৃত দোষীরা ধরা পড়বে না, এমন একটা হতাশা যত ছড়িয়ে পড়েছে, ততই এই ধারণা পোক্ত হচ্ছে যে শাসকের প্রশ্রয়প্রাপ্তদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা নেই পুলিশ-প্রশাসনের। যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ না করলে বিচারব্যবস্থাও অগত্যা ‘নিধিরাম সর্দার’। এই হতাশা যত ছড়াবে, তত বাড়বে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের প্রতি প্রতিকারহীন হিংসা। সেই সব ঘটনা আরও সহজ করবে কর্মরত মেয়েদের উপর অসম, অন্যায় শর্তের আরোপ, লিঙ্গের ভিত্তিতে নানা ধরনের বঞ্চনা, বৈষম্য ও অসম্মান। এ ভাবেই শিকড় গাড়ে ‘রেপ কালচার’। ধর্ষিত মেয়েদের বয়ানে সন্দেহ, ধর্ষণে অভিযুক্তের প্রতি অযৌক্তিক আস্থা, ন্যায়বিচারকে জটিল, দীর্ঘ, অনিশ্চিত প্রক্রিয়া করে তোলা, জনসমক্ষে ধর্ষণকে দৈনন্দিন ঘটনা বলে দেখানো, এ সবই ধর্ষণের সংস্কৃতির লক্ষণ।
এই বিষবৃক্ষ কেবল লিঙ্গবৈষম্য ও নারী-নিপীড়নে সীমিত থাকে না, কর্মক্ষেত্রের সব দিকেই তার ডালপালার প্রসার। আর জি কর কাণ্ডের পর যেমন স্পষ্ট হয়েছে যে মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্বাস্থ্য ভবনের সব স্তরে দীর্ঘ দিন ধরে ছড়িয়েছে দুর্নীতির বিষ। চিকিৎসকদের বদলি, পদোন্নতি থেকে শুরু করে ছাত্রদের পরীক্ষার নম্বরে কারচুপি, স্নাতকোত্তর ছাত্র-চিকিৎসকদের বা ইন্টার্নদের নিয়োগ, এ সব কিছুর পিছনে একটি দুর্নীতি চক্র কাজ করছে। রাজ্যের সব পাচার ও প্রতারণার চক্র এ ভাবেই কাজ করে। এগুলির আবর্তনের পথে যা কিছু আসছে, তার অপসারণ করতে হিংসার অবাধ প্রয়োগকে ‘স্বাভাবিক’ ও ‘প্রত্যাশিত’ করে তোলায় সরকার বা শাসক দল যেন অন্যায় কিছু দেখছে না। রাজ্যের সব কর্মক্ষেত্রকে ‘আর জি কর’ করার শক্তিই আজ ক্ষমতার পরিচয়।