উনিশশো বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের বয়স হইল সত্তর
একুশে ফেব্রুয়ারি আসিতেছে, উনিশশো বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের বয়স হইল সত্তর। কেবল বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরাই নহে, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের বাংলাভাষী মানুষ মাত্রেই গর্ববোধ করিতে পারেন, মাতৃভাষার অধিকার ঘিরিয়া বাঙালি ১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথে নামিয়াছিল, শাসকের চাপাইয়া দেওয়া ‘ভাষা শাসন’-এর প্রতিবাদে শুধু কণ্ঠ নহে, প্রাণ দিয়াছিল। মাতৃভাষার জন্য এই অভূতপূর্ব ত্যাগ দুই দশক পরে হইয়া উঠিয়াছিল স্বাধীনতা সংগ্রামেরও অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি; ১৯৭১-এ নূতন, স্বাধীন রাষ্ট্রের নামকরণে ‘বাংলা’ ও ‘দেশ’ শব্দদ্বয় পাশাপাশি রাখিবার সহজ ও গভীর ভাবনাতেই মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির পারস্পরিক সম্বন্ধটি ব্যক্ত। যে কেহ যে কোনও স্থানে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারণ করিতেছেন, বাংলা ভাষাকে ঘিরিয়া বাঙালির চেতনা ও আত্মত্যাগের ইতিহাসকে জ্ঞানত বা অজানিতে স্মরণ করিতেছেন।
আবেগ এক জিনিস, চেতনা ভিন্ন। ভাষা চেতনার কতকাংশ আবেগ দিয়াই নির্মিত, প্রতি বৎসর একুশে ফেব্রুয়ারি তাহার গদগদ প্রকাশ গণ ও সমাজমাধ্যমে দেখাও যায়, বাংলা ভাষা কত মিষ্ট মধুর অথচ অন্য ভাষাসমূহের চাপ ও দাপটে ইদানীং সন্ত্রস্ত, তাহা লইয়া আক্ষেপ ও ক্রোধ। ভাষা চেতনার কথা বলিলে কেহ জিভ কাটিবেন, কেহ নিরুত্তর থাকিবেন, কেহ প্রতিপ্রশ্ন করিয়া বসিতে পারেন: উহা কী জিনিস, খায় না মাথায় দেয়? মাতৃভাষা এখন অনেক বাঙালির ‘মুখের ভাষা’ও নাই, বেসরকারি আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠরত এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি বলিতেই উৎসাহ দেওয়া হয়, বহুজাতিক কর্মস্থলেও ইংরেজির প্রাবল্য, পশ্চিমবঙ্গে ব্যাঙ্ক শপিং মল রেস্তরাঁ-সহ নানা স্থানে হিন্দির আগ্রাসন লইয়া অনেক কথা উঠে। কয়েক বৎসর আগে বাংলাদেশে নরম পানীয়ের বোতলের গায়ে ‘অবিমিশ্র’, ‘পয়মন্ত’, ‘বিপ্রতীপ’ ইত্যাদি একুশটি বাংলা শব্দের উপস্থাপনে নূতন প্রজন্মকে মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতন করিবার চেষ্টা নজর কাড়িয়াছিল। যে দেশ সারা বিশ্বকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ উপহার দিয়াছে, ভাষা আন্দোলনের সাত দশক ও স্বাধীন হইবার পাঁচ দশকের মধ্যে সেই দেশেই নবপ্রজন্মকে বাংলা শিখাইতে হইতেছে, তাহাও নরম পানীয় বিক্রয়ের ব্যবসায়িক কৌশলে— বিতর্কও কম হয় নাই। আবার বিপরীত চিত্রটিও আছে, ইংরেজি মাধ্যমে পাঠরত সন্তানের গুণগান গাইতে ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ বলিয়া কটাক্ষ; নির্বাধ ইংরেজি বলিতে পারা বঙ্গসন্তান পরিবার সমাজ তথা জনমানসে খানিক উচ্চাসনেই বিরাজ করেন। মাতৃভাষা লইয়া এই যুগপৎ আবেগ ও হতাশা, গর্ব ও হীনম্মন্যতা বাঙালির ভাষিক চরিত্রের অমোঘ অভিজ্ঞান: গ্রামীণ বাদাম-বিক্রেতার মুখের বাংলা গান বিশ্ব জুড়িয়া ‘ভাইরাল’ হইলে সে মাতৃভাষাগর্বের শরিক হইবে, আবার এক জন জীবনানন্দ দাশ বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্রেফ বাংলা ভাষাতেই লিখিলেন বলিয়া বিশ্ব তাঁহাদের চিনিল না, এই বিলাপেও গলা মিলাইবে।
ইংরেজি বা হিন্দির সহিত ব্যবহারিকতার দৌড়ে বাংলা ভাষা পিছাইয়া পড়িতেছে, মনে করেন অনেক বাঙালিই। তাঁহাদের একাংশের মনোভাবও তাই যুদ্ধং দেহি: রোজকার জীবনে অমুক ভাষা কামান দাগিতেছে, আমিও বাংলা ভাষার গুলতি ছুড়িব। বাংলা ভাষার নামে দল গোষ্ঠী পক্ষ তৈরি হইয়াছে, যেখানে যখনই বাংলা ভাষার অবমাননার অভিযোগ আসে, তাঁহারা প্রতিবাদে মুখর হন, সংঘর্ষেরও খবর আসে। ঢাকার রাজপথে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন হইয়াছিল ‘একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ হিসাবে উর্দুকে চাপাইয়া দিবার ঘোষণা তথা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদী ছাত্র জনতা যে স্লোগান দিয়াছিলেন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, তাহার অর্থ ‘উর্দুর পরিবর্তে বাংলা’ নহে, তাহার অর্থ উর্দুর পাশাপাশি, সমগুরুত্বে ও মর্যাদায় বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার দাবি। শাসক তাহা স্বীকার করে নাই বলিয়াই আন্দোলন হইয়াছিল, রক্ত ঝরিয়াছিল। আজিকার বাঙালিকেও বুঝিতে হইবে, একুশে ফেব্রুয়ারি একমাত্র বাংলা ভাষার দিন নহে, বিশ্বের সকল স্থানের, সকল মানুষের নিজ নিজ মাতৃভাষাকে সম্মান করিবার একটি প্রতীকী দিন। বিশ্বের সামনে এই দিনটি তুলিয়া ধরিবার সূত্রটি বাংলা ভাষা, ইহা অতুল সম্মানের। ভাষা ঘিরিয়া এই আবেগ চেতনায় সঞ্চারিত হউক, তাহাই উদ্দেশ্য। অন্য ভাষার সহিত বাংলার মাপামাপিতে মরমে মরিয়া, বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষাকে অপমান করিয়া সেই চেতনা আসিবে না। মাতৃভাষা-সংস্কৃতির নিবিড় চর্চা, সযত্ন রক্ষণ, উদার প্রসারেই তাহা আসিতে পারে। তাহাই ‘গরব’, তাহাতেই ‘আশা’।