রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে গোড়া থেকেই উত্তাপ বা উত্তেজনার কোনও কারণ ছিল না। কিন্তু তার পরেও সোমবার ভোটগ্রহণের আনুষ্ঠানিক পর্ব সম্পূর্ণ নিরুত্তাপ থাকেনি। তার কারণ: ক্রস ভোটিং, বাংলায় যাকে উল্টো-ভোট বলে অভিহিত করা যেতে পারে। অনেকগুলি রাজ্যেই বিজেপি-বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের একাংশ যশবন্ত সিন্হার বদলে দ্রৌপদী মুর্মুকে ভোট দিয়েছেন বলে জল্পনা, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরাই সেই খবর জানিয়ে দিয়েছেন। কোথাও কোথাও, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বিপরীতও ঘটে থাকতে পারে, অর্থাৎ এনডিএ-র হিসাবের ভোট হয়তো তৃণমূল কংগ্রেসের টানে বিরোধী ঝুলিতে জমা পড়েছে। তবে সব মিলিয়ে এই উল্টো-ভোটের কল্যাণে নাকি দ্রৌপদী মুর্মুরই বাড়তি সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা। আপাতত অবশ্য সমস্ত অঙ্কই সম্ভাবনার স্তরে— গোপন ব্যালটে কে কত ভোট পেয়েছেন তার পাকা খবর জানা যাবে ব্যালট বাক্স খোলার পরে।
এক অর্থে অবশ্য এই সব গরমিল নিয়ে উত্তেজনার কোনও কারণ নেই। প্রথমত, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে উল্টো-ভোটকে বেআইনি বা অন্যায় বলা চলে না; দ্বিতীয়ত, অতীতেও এমন অঘটন একাধিক বার ঘটেছে। সংসদে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় অথবা আস্থা বা অনাস্থা ভোটের ক্ষেত্রে ভোট হয় প্রকাশ্যে, সেখানে অনেক সময়েই বিভিন্ন দল আপন সদস্যদের উপর ‘হুইপ’ অর্থাৎ আদেশ জারি করে, আদেশ অমান্য করলে শাস্তির আশঙ্কা থাকে। গোপন ব্যালটের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তেমন নির্দেশ দেওয়া হয় না, তার প্রশ্নও ওঠে না, কারণ কে কাকে ভোট দিয়েছেন তা জানা সম্ভব নয়। তবে এ ক্ষেত্রে একটা নীতিগত যুক্তিও আছে— রাষ্ট্রপতির পদে সাংসদ-বিধায়করা কাকে সমর্থন করবেন, সেটা নিছক দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার হওয়া উচিত নয়, নির্বাচক হিসাবে এক জন জনপ্রতিনিধির ব্যক্তিগত পছন্দ বা অভিমতেরও মর্যাদা থাকা উচিত। এই যুক্তির সূত্র ধরেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বারংবার ‘বিবেক ভোট’-এর প্রশ্ন উঠেছে— নির্বাচকদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আপন বিবেকের নির্দেশে ভোট দিতে বলা হয়েছে।১৯৬৯ সালে কংগ্রেসের মনোনীত প্রার্থী সঞ্জীব রেড্ডির প্রতিদ্বন্দ্বী ভি ভি গিরিকে জয়ী করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিবেক ভোটের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২০১২ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বিপুল জয়ের পিছনে ক্রস ভোটিংয়ের অবদান বহু-আলোচিত, তখনও বিবেক ভোটের কথা শোনা গিয়েছিল। এ-বারেও যশবন্ত সিন্হা তাঁর ভূতপূর্ব সতীর্থদের বিবেকের ডাক শুনে ভোট দিতে আবেদন জানিয়েছেন।
প্রশ্ন হল, যাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তের বিপরীতে ভোট দেন, তাঁরা কতটা বিবেকের ডাকে সে-কাজ করেন আর কতটা অন্য কোনও তাড়নায় বা অনুপ্রেরণায়? রাজনীতিতে, বিশেষত ভারতীয় রাজনীতিতে বিবেকের ভূমিকা বস্তুটি বরাবরই গভীর সংশয়ে আচ্ছন্ন থেকেছে। তবে এই অপ্রিয় সত্যটিও অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, কালক্রমে সেই সংশয় গভীরতর হয়েছে। বস্তুত, আজ ভারতীয় রাজনীতি যেখানে পৌঁছেছে, সেখানে ‘বিবেক ভোট’ কথাটাই নাগরিকের কানে পরিহাসের মতো শোনাতে বাধ্য। এ-বারেও উল্টো-ভোটের পিছনে টাকার খেলার অভিযোগ উঠেছে। খেলা অবশ্য কেবল টাকার হয় না, ক্ষমতার অন্য আকর্ষণও থাকে, যেমন থাকে ক্ষমতার দাপটে সমস্যায় পড়বার ভয়ও, সেই আকর্ষণে বা ভয়ে কোনও জনপ্রতিনিধির ‘বিবেক’ যদি উল্টো দিকে ভোট দেয়, ভূয়োদর্শী দেশবাসীরা আজ আর তাতে কিছুমাত্র বিস্মিত হবেন বলে মনে হয় না। তাঁরা বুঝে নিয়েছেন, গণতন্ত্র বস্তুটি স্বভাবে অনেকটা জলেরই মতো, তাকে যে পাত্রে ঢালা হয়, সে তার আকার ধারণ করে। উল্টো দিকে ভোট দেওয়ার সুযোগ যদি থাকে, উল্টো-ভোট কেন বাধ্যতে?