প্রতীকী ছবি।
এডস, ক্যানসার প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত যে রোগীদের আর রোগমুক্তির সম্ভাবনা থাকে না, তাঁদের প্রয়োজন হয় প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা উপশম চিকিৎসা। অর্থাৎ রোগযন্ত্রণাকে সহনীয় করার, এবং অবশিষ্ট দিনগুলিতে জীবনের মান যথাসম্ভব উন্নত করার সহায়ক চিকিৎসা। ভারতে প্রতি বছর পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রয়োজন হয় এমন চিকিৎসার, কিন্তু অতি সামান্য অংশেরই তা মেলে। এমনকি নামীদামি হাসপাতালেও বহু আসন্ন-মৃত্যু রোগীর শেষ দিনগুলি কাটে একাকী, আচ্ছন্ন, অসহায় অবস্থায়। স্বজন-পরিবৃত হয়ে মৃত্যুর আশা অধরা থেকে যায়। সম্প্রতি কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতাল নিকটবর্তী ক্যানসার রোগীদের বাড়িতে গিয়ে উপশম চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। প্রয়োজনে বিনা খরচে চিকিৎসা দেওয়ার ঘোষণাও করেছে। এই উদ্যোগ সাধুবাদার্হ। কিন্তু, এতে বিপুল চাহিদার কতখানি মিটতে পারে? বিশেষত দরিদ্র রোগীদের পক্ষে উপশম চিকিৎসার নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্য। তীব্র যন্ত্রণা তাঁদের জীবনের শেষ দিনগুলিকে দুর্বিষহ করে তোলে।
উপশম চিকিৎসাকে সহজলভ্য করার পক্ষে বহু দিন ধরেই সওয়াল করে আসছেন চিকিৎসকেরা। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই ভারতে উপশম চিকিৎসার সূচনা হয়। জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল এ বিষয়ে একটি স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ্যক্রম চালু করে ২০১২ সালে। উপশম চিকিৎসার পরিকল্পনা (‘ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর প্যালিয়েটিভ কেয়ার’) তৈরি হয়েছে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের অধীনে। কিন্তু তার জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ হয়নি। ক্যানসার, ডায়াবিটিস, স্ট্রোক প্রভৃতি রোগের নিয়ন্ত্রণের নানা প্রকল্প থেকেই উপশম চিকিৎসার প্রয়োজন মেটানো হবে, এমনই ধরে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে উপশম চিকিৎসার প্রসার হয়নি। খুব অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানেই উপশম চিকিৎসার পাঠ পড়ানো হয়। চিকিৎসকরাও তেমন উৎসাহী নন, হয়তো রোগী ‘সুস্থ’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই বলে। এর প্রতিফলন পড়েছে চিকিৎসাজগতের মূল্যায়নেও— ‘কোয়ালিটি অব ডেথ ইনডেক্স’-এ ভারতের স্থান নীচের দিকে।
উপশম চিকিৎসা সুলভ না হওয়ায় রোগী যেমন যথাযথ পরিষেবা পান না, তেমন চিকিৎসার পরিকাঠামোরও যথাযথ উপযোগ হয় না। শীর্ষ স্তরের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এমন অনেক মৃত্যুপথযাত্রীকে, যাঁদের বস্তুত মাঝের স্তরের হাসপাতালে রেখে, অথবা বাড়িতে রেখে উপশম চিকিৎসায় আরাম দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। ভারতের শীর্ষ হাসপাতালগুলির উপরে এমনিতেই প্রচুর রোগীর চাপ, অপরিকল্পিত শয্যা ব্যবহারের ফলে সে চাপ আরও বাড়ে। চিকিৎসা বিফল জেনেও বিকল্পের সন্ধান মেলে না বলে প্রচুর অর্থ খরচ হয় রোগীর পরিবারের। উপশম চিকিৎসা মনে করায়, রোগের লক্ষণের চিকিৎসা না করে রোগীর চিকিৎসা করা প্রয়োজন। যে রোগীর যেমন প্রত্যাশা, যা প্রয়োজন, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চিকিৎসা করতে হবে। অনেকেই আয়ু আরও দীর্ঘ না করে, বরং শেষ দিনগুলি সজাগ, সচেতন ভাবে কাটাতে চান। তেমন সুযোগ তাঁকে দেওয়ার মতো অগ্রগতি হয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রের। স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের পথ করে দিতে হবে, যাতে সে চিকিৎসা পৌঁছয় রোগীর কাছে। মরণাপন্নের শেষ দিনগুলি শান্তিময় ও বেদনাহীন করতে না পারা চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যর্থতা।