প্রতীকী ছবি।
পঞ্চায়েতি রাজ এ দেশে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৯৩ সালের ২৪ এপ্রিল। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে ঘটনাটি সঙ্গত কারণেই এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত। সম্প্রতি সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের তিন দশক পূর্ণ হয়েছে। এমন একটি সময়ে রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন সমাসন্ন, তার উদ্যোগপর্ব চলছে। সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি ভোটদাতা ৩৩১৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৩৪১টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ২০টি জেলা পরিষদে প্রতিনিধিদের নির্বাচন করবেন— প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের এই অনুশীলন কেবল অবশিষ্ট ভারতের কাছেই নয়, বৃহত্তর দুনিয়ার চোখেও পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদা বৃদ্ধির একটি অসামান্য সুযোগ এনে দিয়েছে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার হবে কি? সমস্ত প্রস্তুতি ও প্রচারের শেষে ৮ জুলাই নির্বাচন সুসম্পন্ন করে এই রাজ্য কি বিশ্বপৃথিবীকে সগৌরবে জানাতে পারবে: আমরা গণতন্ত্রের সাধনায় সুস্থিত?
বঙ্গজননী এই প্রশ্ন শুনে বোধ করি নিমচাঁদের ভাষায় গেয়ে উঠবেন: কি বোল বলিলে বাবা বলো আর বার, মৃতদেহে হল মম জীবনসঞ্চার। দীনবন্ধু মিত্র বিরচিত সধবার একাদশী-র সেই সমাপ্তি-সঙ্গীতে যে তীব্র এবং করুণ ব্যঙ্গ ও তিরস্কার নিহিত, পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-রাজনীতির পক্ষে তা-ও যথেষ্ট নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ফলিত রূপটি এই রাজ্যে প্রতিনিয়ত এক ভয়াবহ আকারে মূর্ত হয়ে চলেছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঢাকে কাঠি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যবাসীর মনে আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়েছে— বিভীষিকার মাত্রা কি আরও কয়েক পর্দা চড়বে? এবং, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার অধ্যায় শুরু হওয়ার সঙ্গে আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এ রাজ্যে নির্বাচনে, বিশেষত পঞ্চায়েত নির্বাচনে রক্তক্ষয়ী এবং প্রাণান্তকারী হিংস্র সংঘর্ষের যে ধারা তৈরি হয়েছে, এ বারেও তা ইতিমধ্যেই প্রকট। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের রক্তাক্ত স্মৃতি এখনও অতিমাত্রায় প্রবল। সেই হিংস্র তাণ্ডবের কারণে পশ্চিমবঙ্গের নাম দেশে ও দুনিয়ায় খ্যাত হয়েছিল। ২০২৩ কি সেই কুখ্যাতির ভান্ডারে নতুন শিরোপা এনে দেবে?
এই সংঘাতের দায়ভাগ নিয়ে অনন্ত তরজা চলছে এবং চলবে। কিন্তু একটি মৌলিক এবং প্রাথমিক সত্য স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করা দরকার। রাজ্যের শাসনভার যাঁদের হাতে, কলঙ্ক মোচনের দায়িত্ব তাঁদেরই। তাঁদের রাজ্যশাসনের এক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। নির্বাচনী রাজনীতির হিংস্রতায় সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গ কেবল প্রথম নয়, অ-তুলনীয়— এই সত্য শাসক দল ও তার নেতৃত্বের পক্ষে চরম লজ্জার কারণ। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ— অধুনা তিহাড়-নিবাসী দলীয় নেতার জেলায় প্রায় ৯০ শতাংশ— আসনে তাঁদের প্রার্থীরাই ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়েছিলেন। সুশাসনের হাল কোথায় পৌঁছলে গণতন্ত্রের এমন সলিলসমাধি সম্ভব হতে পারে! অথচ শাসকদের আচরণে তা নিয়ে কোনও লজ্জাবোধ দেখা যায়নি, বরং তাঁরা তারস্বরে এ জন্য বিরোধীদের ‘অপ্রস্তুতি’কে দায়ী করেছিলেন। এ বারেও মনোনয়ন পর্বে বিরোধীদের সামনে বাধা সৃষ্টি করা থেকে শুরু করে ভয় দেখানো, হিংস্র আক্রমণ ইত্যাদি পরিচিত অভিযোগ বিস্তর শোনা যাচ্ছে। তার পাশাপাশি শাসক দলের নায়কদের ‘জনসংযোগ অভিযাত্রা’ যে ভাবে দাপট দেখানোর অভিযানে পর্যবসিত হচ্ছে, যে ভাষায় তাঁরা অত্যন্ত নিচু স্তরের ময়দানি রণহুঙ্কারে রাজনীতির হাওয়া গরম করতে ব্যস্ত হচ্ছেন, তা কোনও গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দেয় না। বিরোধীদের আচরণও বহু ক্ষেত্রেই নিন্দনীয়, কিন্তু, আবারও বলা দরকার, অনাচারের দায় এবং সুস্থিতির দায়িত্ব প্রধানত শাসকের, কারণ তাঁরা শাসক। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে এলাকা (এবং সম্পদ) দখলের উন্মত্ত লড়াই থেকে সুস্থ বিকেন্দ্রীকরণের অনুশীলনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা যদি তাঁদের থাকে, তবে তার প্রমাণ দেওয়ার জন্য আগামী তিন সপ্তাহ অতি প্রশস্ত সময়।