—প্রতীকী ছবি।
ন’শো কুড়ি আর ছ’শো পঁয়ত্রিশের মধ্যে পার্থক্যটি কম না বেশি? যেমনই হোক, দুই সংখ্যার দূরত্বটিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কৃতিত্ব-তালিকায় লিখে রাখতে পারেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য বহু দশকব্যাপী সন্ত্রাস-উপদ্রুত, বিচ্ছিন্নতাবাদ-জর্জরিত জম্মু ও কাশ্মীরের থেকেও দু’শো পঁচাশি কোম্পানি বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ করা হল। এই পালক রাজ্যের মুকুটে যুক্ত হওয়ার মুহূর্তটি তামাম রাজ্যবাসীর কাছেই ‘গৌরব’জনক বইকি। ইলেকশন কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে যে বার্তা প্রেরণ করেছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে নেতি-আলোকে উদ্ভাসিত করার রাজনৈতিক অভিসন্ধি থাকতেও পারে— তৃণমূল-শাসিত পশ্চিমবঙ্গকে হেনস্থা করার বিন্দুমাত্র সুযোগ ছাড়তে যে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার অনিচ্ছুক, বারংবার প্রমাণিত। কিন্তু তার সঙ্গে আরও কিছু কথা যথেষ্টরও বেশি পরিমাণে প্রমাণিত পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব বাস্তব-বিষয়ে— অন্য কোনও রাজনীতি বা অন্য কারও পর্যবেক্ষণ-নিরপেক্ষ ভাবেই।
গত কয়েক বছর ধরে ভোটের সময় দেশের মধ্যে সর্বাধিক হিংসাপ্রবণ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। মাত্র কয়েক মাস আগে রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটে সংঘর্ষ ও রক্তপাতের যে নমুনা দেখা গিয়েছে, তা গোটা দেশের সংবাদ-শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিল। সংবাদ হওয়াটাই বড় কথা নয়, আসল ভয়ঙ্কর কথাটি হল, বহু সতর্কতা সত্ত্বেও, সম্ভবত উপরিতলের নেতৃত্বের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করেও, এই হিংসাপ্রবাহ আটকানো যায়নি। মনে করা জরুরি যে, ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া নিয়েই এমন মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, কংগ্রেস ও বিজেপি দুই বিরোধী দলকেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হতে হয়। মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, পূর্ব বর্ধমান, কোচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা কেঁপে ওঠে বোমা বিস্ফোরণ, অগ্নিসংযোগ, ছুরিকাঘাত, ধারালো অস্ত্রে অঙ্গকর্তনের একের পর এক ঘটনায়। খেলনা ভেবে বোমা হাতে নেওয়া শিশু যখন মৃত্যু-কোলে ঢলে পড়ে, মনোনয়ন-কামী ব্যক্তির স্ত্রীরা যখন সাদা থানের হুমকি পান— সভ্যতার মর্যাদা খুইয়েছিল এই রাজ্য। একই চিত্র ছিল ২০১৮ সালেও। শুভেন্দু অধিকারী আর অধীররঞ্জন চৌধুরী প্রায় এক নিন্দা-ভাষায় হলফনামা দিলেন ২০২৩-এর জুন মাসে। কম কথা নয়। তার ভিত্তিতে হাই কোর্টের রায় ছিল, নির্বাচন কমিশনকে প্রতি জেলায় এক কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী বহাল করতে হবে। এই সব ঘটনা যখন ঘটছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক আশ্চর্য দায়িত্বস্খলনের উদাহরণ তৈরি করছিলেন বিরোধীদের উপর এই হিংসার সমগ্র দায় চাপিয়ে। বিরোধীরা যত অনাচারই করুক, শেষ পর্যন্ত রাজ্যের প্রশাসন নামক বস্তুটি যে তাঁরই হাতে, এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা যে তাঁরই অঙ্গুলিহেলনের দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষারত, এ কি কারও বুঝতে অসুবিধা হতে পারে?
স্বীকার করতেই হবে, ভোটহিংসার এই বিশেষ ঐতিহ্য পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসই প্রথম আমদানি করেনি— বাম আমলেও এর প্রকোপ ছিল প্রবল, এমনকি বাম জমানার আগেও এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল অতিরিক্ত সংঘর্ষময়। আজ সিপিএম অনুরাগীরা যতই সরকারের নিন্দায় মুখর হোন না কেন, তাঁদের স্মৃতি উস্কে দিয়ে বলতেই হবে, ভোটে সমাজবিরোধীদের দেদার কাজে লাগানো থেকে শুরু করে সমস্ত ঘরানার হিংসাকাণ্ডকেই এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বটি বামেদেরই। তৃণমূল আজ সেই ঘরানার ‘রেওয়াজ’টিকে অভূতপূর্ব উচ্চতায় উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে। একই ভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও মনে রাখতে হবে, তৃতীয় বারের মুখ্যমন্ত্রিত্ব-পর্বের মাঝামাঝি এসে কিন্তু অন্য কারও উপর এই হিংসারাজ্যের দায় তিনি চাপাতে পারেন না। ভাবের ঘরে চুরি ছেড়ে তিনি স্বীকার করে নিন, এক ভিন্ন অর্থে দেশের মধ্যে সবচেয়ে ‘বিমারু’ রাজ্য এখন তাঁর পশ্চিমবঙ্গই।