Manipur Violence

চোরাবালির টান

ভোটের অব্যবহিত পরেই আবার হিংসায় ডুবছে মণিপুর। বাড়িঘরে আগুন লাগানো, ট্রাক-বাস ইত্যাদি জ্বালিয়ে দেওয়া— অব্যাহত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৪ ০৭:৫৯
Share:

—ফাইল চিত্র।

জনরায়ের সামনে নত হতে বাধ্য হওয়া, এবং শান্তি স্থাপনের কাজে ব্যর্থতার জন্য লজ্জা স্বীকার করা, এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। মণিপুরে এক বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভয়াবহ হিংসা চলার পর লোকসভা ভোটে সমূহ পরাজিত রাজ্যে শাসক দল বিজেপির নেতা হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহ-র কথা শুনে সেই কথাটিই মনে হতে পারে। ভোটের পর প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি যদিও বললেন যে, গত এক বছর ধরে মণিপুর হিংসা সামাল দিতে রাজ্য সরকার ব্যর্থ হয়েছে— তাঁর কথার মধ্যে বিন্দুমাত্র আত্মগ্লানি বা আক্ষেপ খুঁজে পাওয়া কার্যত অসম্ভব। রাজ্য সরকারের যা কিছু করণীয়, কোনওটিই ঠিক ভাবে না করার যে বিপুল খেসারত মণিপুরবাসীকে এক বছর ধরে দিতে হয়েছে, তাতে কেবল মণিপুর নয়, গোটা দেশের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে বিপুল লজ্জায়। তার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের উপেক্ষাও অক্ষমার্হ: অমানবিকতার এই বিস্ফোরণ সাতাত্তর বছরের স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে ঘটে চলেছে, অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্কট মোকাবিলার চেষ্টাই হল না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে লোকসভা আসনে কংগ্রেসের জয় শাসক বিজেপির কাছে একটি গুরুতর বার্তা— কিন্তু রাজ্য নেতৃত্ব তা মন দিয়ে পড়ছেন বলে মনে হয় না। শাসক বিজেপির প্রতি রাজ্যের সাধারণ মানুষের ক্ষোভের যে বিবিধ বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রতিক কালে দেখা গিয়েছে, সরকার রাজ্যের পরিস্থিতির কোনও সমাধানসূত্র বার না-করা অবধি তা থামবে না বলেই আশঙ্কা হয়। দিল্লির মুখপানে চেয়ে লাভের বদলে অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে— প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় দফার শাসন শুরু করেও এক বারও এ দিকে মন দেওয়ার সময় পাননি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও গত বছর যথেষ্ট অবহেলা দেখিয়েছেন। রাজ্য নেতারা কি এখনও বুঝছেন না যে, তাঁদের রাজ্যের বাস্তব অন্যদের মাথাব্যথা নয়— তাঁদেরই তা দক্ষ ভাবে চালনা করতে হবে।

Advertisement

ভোটের অব্যবহিত পরেই আবার হিংসায় ডুবছে মণিপুর। বাড়িঘরে আগুন লাগানো, ট্রাক-বাস ইত্যাদি জ্বালিয়ে দেওয়া— অব্যাহত। এখনও রাজ্যে ষাট হাজার মানুষ ঘরছাড়া। দশ হাজারেরও বেশি মানুষ অন্য রাজ্যে পালিয়ে গিয়েছেন। শুধু সত্তাপরিচয়ের রাজনীতিই এই মিশ্র জনসমাজ অধ্যুষিত রাজ্যের হিংসার একমাত্র কারণ নয়। গোষ্ঠী-সংঘর্ষ যদি হয় এক দিকের বাস্তব, সেই সংঘর্ষের উপলক্ষটি কিন্তু অর্থনৈতিক সুযোগ ও তার ভিত্তিতে সামাজিক সুরক্ষার দাবি। এই দাবি মেটানোর বিষয়ে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত রাজ্যটিতে সরকার কি তার দায় ও দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে? ভারতে মাথাপিছু আয়ের হিসাবে মণিপুর শেষ দিক থেকে তৃতীয় স্থানে। কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলে সমস্যার সমাধান করা যাবে না, সেনাবাহিনী নামিয়েও না। সম্পদের অধিকারকে কেন্দ্র করে গোষ্ঠীসংঘর্ষ অগ্ন্যুৎপাদক হয়ে উঠলে আগুন মোকাবিলা করেই তা থামানো যায় না। দরকার সম্পদের সুষম বণ্টনের ভাবনা, সর্বজনীন অধিকারের দিকে মনোযোগ। এখনও সেই বোধ জাগ্রত না-হওয়া অমার্জনীয় অপরাধ।

এ দিকে এরই মধ্যে সামনের সেপ্টেম্বর মাসে সে রাজ্যে পঞ্চায়েত, পুরসভা ও জেলা পরিষদের নির্বাচনের ঘোষণা শোনা গেল। হিংসাদীর্ণ পরিস্থিতিতে আবার ভোট হবে শুনে নাগরিকরা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছেন— লোকসভা ভোটের সন্ত্রাসস্মৃতি এখনও তাঁদের পিছু ছাড়েনি। যেহেতু লোকসভার দু’টি আসনই বিজেপি ও তাদের শরিক এনপিএফ-এর হাত থেকে কংগ্রেসের কাছে চলে গিয়েছে, হিংসা আরও বাড়তে পারে বলেই অভিজ্ঞদের আশঙ্কা। তার মধ্যে মণিপুরের নাগা সংগঠন ইউনাইটেড নাগা কাউন্সিল (ইউএনসি) জানিয়ে দিয়েছে, তারা কংগ্রেসের জয়ী সাংসদ এবং দুই নির্দল প্রার্থীকে বয়কট করছে। মণিপুর যেন ক্রমশই স্বার্থদুষ্ট রাজনীতির চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম করছে। বাকি ভারত? নীরব দর্শক।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement