WB Panchayat Election 2023

ক্ষমতার উৎস

নির্বাচনপর্বটি যাতে শান্তিপূর্ণ হতে পারে, তা নিশ্চিত করার দায় ছিল রাজ্যের শাসক দলেরও— বিশেষত ২০১৮ সালের কলঙ্কিত অধ্যায়ের পর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২৩ ০৬:৩৭
Share:

পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে। ছবি: সামসুল হুদা।

রাজ্যে প্রশাসন বলে আদৌ কিছু অবশিষ্ট রয়েছে কি? পঞ্চায়েত নির্বাচন মনোনয়নপত্র পেশ করা নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে নিরবচ্ছিন্ন সন্ত্রাস চলছে, প্রশাসন যন্ত্রটি সম্পূর্ণ বিকল না হলে তা কি ঘটতে পারত? পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে রক্তক্ষয়ী অশান্তি হবেই, তা এক প্রকার নিশ্চিত ছিল— ২০১৮ সালে যা ঘটেছিল, তার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা ছিল সব মহলেই। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের দখল রাখার সঙ্গে অর্থনৈতিক ‘খাজনা’ আদায়ের সম্পর্কটি এত ঘনিষ্ঠ এবং অবিচ্ছেদ্য যে, সেই নির্বাচনের গুরুত্বকে শুধু রাজনৈতিক মাপকাঠিতে মাপা যায় না— দখল রাখা বা কায়েম করার জন্য হিংসা হবেই, প্রশাসনের সেই উদ্বেগ ছিল না? ২০১৮ সালের হিংসা দেখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কুশীলবদের মনে পরিবর্তন ঘটেছে— প্রশাসন কি এমনটাই ধরে নিয়েছিল? না কি, হিংসা ঘটলে তাতেও কিছু সুবিধা বা ‘লাভ’-এর আশা আছে? নচেৎ, সন্ত্রাস দমনে এ-হেন ব্যর্থতার কারণ কী? রাজ্যের সর্বত্র যে পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র বেরিয়ে আসছে, তা ভয়ঙ্কর। শুধু লাঠিসোঁটা নয়, বোমা-বন্দুকের প্রাবল্য জানান দিচ্ছে যে, এই হিংসা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আকস্মিকও নয়— এর পিছনে রীতিমতো প্রস্তুতি রয়েছে। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে অনতিপ্রচ্ছন্ন অস্ত্র কারখানা তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশাসনের ধারণামাত্র ছিল না, তা কি হতে পারে? পুলিশ-প্রশাসন কি ধরেই নিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গ একটি মুক্তাঞ্চল, এখানে সংগঠিত রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের হাতে বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস?

Advertisement

ধরে নেওয়াই যেত যে, নির্বাচনী হিংসায় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার পিছনে রয়েছে শাসক দলের প্রতি আনুগত্য। কেননা, রাজনৈতিক হিংসার সিংহভাগই সংঘটিত হয় শাসক দলের বাহুবলীদের দ্বারা। কিন্তু, ভাঙড়ের ঘটনা সেই অনুমানকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। সম্প্রতি সেখানে যে তাণ্ডব হল, তাতে মার খেয়েছেন মূলত তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা, মেরেছেন আইএসএফ-এর লোকজন। অস্ত্রের পরিমাণেও শাসক-বিরোধীর ফারাক করা মুশকিল ছিল— হয়তো বিরোধীদের দিকেই পাল্লা ঝুঁকে ছিল। সে ক্ষেত্রেও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো। তার থেকেই আশঙ্কা হয় যে, সেই নিষ্ক্রিয়তার যতখানি কারণ রাজনৈতিক আনুগত্য, হয়তো ততটাই নিছক অপদার্থতা। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশবাহিনী হিংসা প্রতিরোধ করার, এবং নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা হারিয়েছে। সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্ট নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনী ব্যবহারের কথা বলেছে। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন যে, নির্বাচনের দিন ঘোষণার পরে যাবতীয় সিদ্ধান্তের এক্তিয়ার যেখানে নির্বাচন কমিশনের, সেখানে আদালতের পরামর্শই বা দরকার হল কেন। কিন্তু, রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের উপর আস্থা বজায় রাখা যে উত্তরোত্তর কঠিন হচ্ছে, সে বিষয়ে অবকাশ নেই। স্বভাবতই সঙ্কীর্ণ স্বার্থান্বেষী রাজনীতি খরতর হয়ে উঠছে, রাজ্যপাল মহাশয় যে ভাব ও ভাষায় হিংসা পরিস্থিতি বিষয়ে মন্তব্য করছেন, তাও অতিরিক্ত আশঙ্কার জন্ম দেয়।

নির্বাচনপর্বটি যাতে শান্তিপূর্ণ হতে পারে, তা নিশ্চিত করার দায় ছিল রাজ্যের শাসক দলেরও— বিশেষত ২০১৮ সালের কলঙ্কিত অধ্যায়ের পর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে যেমন সংযমের বা দলকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার চিহ্নমাত্র নেই, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবজোয়ার যাত্রার দিনগুলিও তেমন বুঝিয়ে দিয়েছে যে, গণতন্ত্রে শাসক দলের রুচি নেই। বিবিধ হুমকি এবং অনতিপ্রচ্ছন্ন জবরদস্তি দিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে সুরটি বেঁধে দিয়েছেন, শাসক দলের যন্ত্র অবিকল সেই সুরেই বাজছে। বিরোধীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, এই অভিযোগটিও তিনি যে ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট যে, আগে বলা শান্তির বাণীগুলি নেহাতই কথার কথা। এ রাজ্যে এখন সবার উপরে হিংসা সত্য। গণতন্ত্রের এই অবমাননাই এখন পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞান।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement