—ফাইল চিত্র।
ভরসাফুর্তি উৎসব নয় বটে, কিন্তু নির্বাচন তো। দেশের মানুষকে তো জানাতে হবে, এই হীরকরাজ্যে তাঁরা যে বেঁচেবর্তে আছেন, তা কেবল হীরক রাজার বদান্যতায়। ফলে, সিদ্ধান্ত হল যে, প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনায় কুড়ি কোটি মানুষকে দেওয়া হবে প্রধানমন্ত্রীর মুখচ্ছবিসম্বলিত ব্যাগ। তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩০০ কোটি টাকাও। মানুষ যেন ব্যাগ দেখেই বুঝতে পারেন, কার দয়ায় তাঁদের পাতে খাবার পৌঁছচ্ছে। এর আগে রেশন দোকানের সামনে প্রধানমন্ত্রীর কাট-আউট লাগানোর ব্যবস্থা হয়েছে। সেনা ছাউনি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র সেলফি পয়েন্ট তৈরির চেষ্টা হয়েছে। বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের ডিসপ্লে-তে নিরন্তর প্রদর্শিত হয় প্রধানমন্ত্রীর মুখখানি। পেট্রল পাম্প থেকে কোভিড টিকার শংসাপত্র, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। প্রধানমন্ত্রী প্রচারপ্রেমী— ২০১৮-১৯ থেকে এখন অবধি কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞাপনবাবদ খরচ হয়েছে ৩০০০ কোটি টাকারও বেশি। কিন্তু, টেলিভিশন-সংবাদপত্র-অনলাইন ও সমাজমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে রেশনব্যাগে বা কোভিডের টিকার শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রীর মুখের ছবি ছাপার চরিত্রগত ফারাক রয়েছে। দ্বিতীয় গোত্রের ক্ষেত্রগুলিতে নাগরিক যখন কোনও সরকারি পরিষেবা পাচ্ছেন, ছবিটি জুড়ে যাচ্ছে সরাসরি তার সঙ্গে। ফলে, গ্রাহকের— বিশেষত, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের প্যাঁচপয়জার সম্বন্ধে অনবহিত গ্রাহকের— কাছে দু’টি জিনিস জুড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। সরকারি পরিষেবা প্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা বোধটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর খাতায় জমা হয়ে যাবে, সেই আশাতেই অবশ্য এ-হেন বিজ্ঞাপন।
রেশনব্যাগে প্রধানমন্ত্রীর ছবিতে আপত্তি উঠেছে যে, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারই রেশনের টাকা দেয় না, রাজ্যগুলিও দেয়। কিন্তু, যদি শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায় রেশন দেওয়া হত, তাতেই বা কী? সে ক্ষেত্রে কি প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেওয়া ন্যায়সঙ্গত হত? না, সেটিও একই রকম অন্যায় হত। অন্যায় শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়ে নিজের প্রচারে নয়, অন্যায় রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের চরিত্র বদলে দিতে চাওয়ায়। প্রধানমন্ত্রী যখন নাগরিকের জন্য কোনও পরিষেবা বা সুবিধার ব্যবস্থা করেন, এবং তিনি যখন নাগরিকদের জন্য বিরোধী দলের সরকারের কোনও সুবিধা হস্তান্তর প্রকল্পের বিরোধিতা করেন, এই সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দু’টি অবস্থান বাঁধা থাকে একটি সুতোয়— এই সুবিধা প্রদানকে তিনি কী চোখে দেখেন, সেই সূত্রে। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ঘটনাটিকে দেখে থাকেন দান হিসাবে— রাজা যেমন সন্তুষ্ট হয়ে বা আপন খুশিতে প্রজাদের মধ্যে অল্পবিস্তর দান করে থাকেন, ‘দাতা’-র ভূমিকায় থাকার সময় প্রধানমন্ত্রীর মনোভাবটি তেমন। আবার, যখন তিনি এই ‘খয়রাতি’র বিরোধী, তখনও তিনি ঘটনাটিকে দেখেন অপ্রয়োজনীয় দান হিসাবেই। রাষ্ট্রের কাছে নাগরিক যে দানপ্রার্থী নন, তাঁরা আপন সংবিধানসিদ্ধ অধিকারবলেই এই সুবিধা দাবি করার যোগ্য, প্রধানমন্ত্রী এই কথাটি স্বীকার করতে নারাজ। খাদ্য নাগরিকের অধিকার। জনগণের অছি হিসাবে নিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত করবেন যে, সেই অধিকার অনুসারে খাদ্য পেতে নাগরিকের যেন বিন্দুমাত্র ক্লেশ না হয়। তিনি দেখবেন, নাগরিকের জীবনের অধিকার বজায় রাখার জন্য যেন যথেষ্ট পরিমাণ টিকার ব্যবস্থা থাকে। এর বাইরে তাঁর আর ভূমিকা নেই। এই কাজ করার জন্য ব্যাগে অথবা শংসাপত্রে নিজের ছবি ছাপানো যায় না। প্রচারের প্রতি সুতীব্র আকর্ষণ থাকলেও নয়।