প্রতীকী ছবি।
কোভিড-যুদ্ধে বহু বাধা। যথেষ্ট সংখ্যক শয্যা-সরঞ্জাম-স্বাস্থ্যকর্মী, কিছুই নাই। নাই পর্যাপ্ত টিকাও। বস্তুত, নানা পরিসরে বহু অপ্রতুলতাই মহামারি বা অতিমারির কালে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অভিভূত করিয়া দেয়। সর্বনাশে পণ্ডিতগণ অর্ধেক ত্যাগ করিয়া থাকেন, অতিমারির কালে কিছু ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করিতে পারিলে সংগ্রামের কাঠিন্য কিঞ্চিৎ লাঘব হয়। যথা, করোনা প্রতিষেধকের স্বত্ব তুলিয়া দিবার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিকট আবেদন জানাইয়াছিল ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা, তাহা সমর্থন করিয়াছে আমেরিকাও। নয়াদিল্লির বক্তব্য, বিশ্বের কতিপয় ধনী দেশ স্বত্ব কুক্ষিগত করিলে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির বহু রাষ্ট্রের টিকা পাইতে অসুবিধা হইবে, আখেরে করোনা-যুদ্ধ মন্দীভূত হইবে। অ-পূর্ব সময়ে অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত লইতে হয়, কিয়ৎদিন বাণিজ্যিক স্বার্থ সরাইয়া রাখিয়া দেশে দেশে সুলভ মূল্যে টিকা পৌঁছাইয়া দেওয়া জরুরি, তাহাতেই যথাসম্ভব দ্রুত গণহারে টিকাদান সম্ভব হইতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান যথার্থ ভাবেই আমেরিকার সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক’ বলিয়াছেন।
প্রশ্ন হইল, স্বত্ব কুক্ষিগত করিবারই বস্তু— যে মেধা এমন জীবনদায়ী বস্তু সৃষ্টি করিয়াছে, তাহা আপনার সৃষ্টির উপর একচ্ছত্র অধিকার পাইবে না কেন? যে বুদ্ধিমত্তা শ্রমের বিনিময়ে অনন্য বস্তুর জন্ম দিল, তাহা হইতে অর্থলাভ হইবে না? বৌদ্ধিক সম্পত্তিতে সৃষ্টিকর্তার পূর্ণ অধিকার, সন্দেহ নাই। কেবল অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাহা পর্যালোচনা করিতে হয়, বৃহত্তর স্বার্থে। স্মরণীয়, ভূতপূর্ব মহামারি এডস-এর কালেও ঔষধে স্বত্ব রাখা হয় নাই, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্তাবলিও শিথিল করা হইয়াছিল। যৎকিঞ্চিৎ হইলেও, ইহার ফলে দুর্দশাগ্রস্ত জনতার নাগালে আসিতে পারিয়াছিল মারি রোধের হাতিয়ার। অতএব অধিকারের দ্বন্দ্বের প্রশ্ন যখন আসে, অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার অধিকারের ফলে যখন চিকিৎসার অধিকার হইতে বঞ্চিত হইতে পারেন সাধারণ মানুষ, তখন অগ্রাধিকারটি ভাবিয়া দেখিতেই হইবে। ভবিষ্যৎকল্পে ভাবিলে, অতিমারি ঠেকাইবার ন্যায় প্রয়োজনীয় কিছু থাকিতে পারে কি? মানুষের মৃত্যুমিছিল রুখিতে না পারিলে, তাহার জীবন বাঁচাইতে না পারিলে, সমগ্র সভ্যতা অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়িবে, যাহার সম্মুখে সকল অত্যাবশ্যক প্রশ্নও লঘু হইয়া যায়।
কিন্তু অধিকারের প্রশ্ন স্থগিত রাখা সহজ নহে। জার্মান সরকারের মত, মেধাস্বত্বের সুরক্ষাই উদ্ভাবনের উৎস, স্বত্ব সংরক্ষণ করিতে না পারিলে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা ফাইজ়ারের কর্তাও জানাইয়াছেন, প্রতিষেধকের উৎপাদন বিঘ্নিত হইবার প্রধান কারণ মেধাস্বত্ব নহে। এবং, স্বত্ব-সুরক্ষায় অর্থনৈতিক স্বার্থ অপেক্ষা গুরুত্ব পাইতেছে গবেষণা ও অসুখ নিয়ন্ত্রণের স্বার্থ— জনতার স্বার্থ। কিন্তু প্রশ্ন হইল, স্বত্বের বাধায় আবিষ্কার যদি অধিকাংশ জনতার নিকট না-ই পৌঁছাইতে পারে, তবে কি স্বার্থের যুক্তিটি যথাযথ হইল? বস্তুত, আবিষ্কারকের অধিকার নিশ্চয়ই থাকিবে, কিন্তু তাহা যেন মানুষের সুস্বাস্থ্য পাইবার অধিকার, যাহা একাধারে মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার, তাহার পথে অন্তরায় না হয়। লাভ, আবিষ্কার ও বৃহত্তর স্বার্থকে এক সঙ্গে চলিতেই হইবে। নচেৎ, কাহারও অধিকারই সুরক্ষিত থাকিবে না।