—প্রতীকী ছবি।
দেশের ছ’টি রাজ্যে সাতটি উপনির্বাচনের ফলাফল দেখে জাতীয় রাজনীতির চলন আন্দাজ করার প্রশ্নই নেই। কিন্তু, ফলাফলগুলি নিতান্ত ফেলনাও নয়। ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরি হওয়ার পর এই প্রথম কোনও নির্বাচন হল। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, সাতটি আসনের মধ্যে একাধিক ক্ষেত্রে যেমন জোটের প্রার্থী ছিলেন, তেমনই আবার জোটভুক্ত দলগুলি পরস্পরের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ বা ততখানি বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, এমন লড়াইও করেছে। যে দু’টি আসনে জোটের প্রার্থী ছিলেন, সে দু’টি আসনেই জোট জয়ী। তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশের ঘোসি বিধানসভার ফলাফলটির তাৎপর্য বহুমাত্রিক। প্রথমত, সে আসনে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত হেভিওয়েট নেতা দারা সিংহ চৌহান, যিনি ২০২২-এর নির্বাচনে ঘোসি থেকেই সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর হয়ে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ-সহ বিজেপির তারকা প্রচারকরা মাঠে নেমেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তার একটি কারণ যদি দারা সিংহ চৌহানের ঘন ঘন দল বদলানোর অভ্যাসে ভোটারদের বিরক্তি হয়, বৃহত্তর কারণটি হল, এই আসনে একের বিরুদ্ধে এক লড়াই হয়েছে। সমাজবাদী পার্টির ভোট গত বারের ৪২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৮ শতাংশ হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি এই নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি, দলীয় সমর্থকদেরও ভোট দিতে বারণ করেছিল। এটি জোট সম্ভাবনার একটি অন্য দিক। ইন্ডিয়া জোটের অন্য প্রার্থী ঝাড়খণ্ডে ডুংরি কেন্দ্র থেকে জয়ী। দু’টি আসনে জয় থেকে বৃহত্তর পর্যবেক্ষণ করা বিপজ্জনক— কিন্তু, বিজেপি-বিরোধী ভোটকে একত্রিত করতে পারলে যে তা তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
যে আসনগুলিতে জোট হয়নি, তার মধ্যে ত্রিপুরায় দু’টি এবং উত্তরাখণ্ডে একটি আসনে বিজেপি জয়ী। অন্য দু’টি আসন— পশ্চিমবঙ্গে ধূপগুড়ি এবং কেরলে পুথুপ্পল্লি— জয়ী যথাক্রমে তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস প্রার্থী। কেরলের আসনে কংগ্রেসের জয়ের ব্যবধান বিপুল, কিন্তু আসনটি গত অর্ধশতকেরও বেশি সময় কংগ্রেসেরই দখলে— প্রয়াত পিতা উমেন চান্ডির আসনে জয়ী হলেন পুত্র চান্ডি উমেন। ধূপগুড়ি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় তুলনায় বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। উত্তরবঙ্গে বিজেপির হাত থেকে তাদের জেতা আসন ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যে যেমন রাজ্যে বিজেপির শক্তিক্ষয়ের ইঙ্গিত রয়েছে, তেমনই রাজ্য রাজনীতিতে বাম ও কংগ্রেসের প্রতি বার্তাও রয়েছে। তারা রাজ্যে ইন্ডিয়া জোটের শরিক হিসাবে লড়বে কি না, তা নিতান্তই দলীয় বিবেচনা, কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্টের সাড়ে বারো শতাংশ ভোট এই উপনির্বাচনে ফের ছয় শতাংশের নীচে নেমে আসায় যে ইঙ্গিতটি রয়েছে, তাকে অগ্রাহ্য করা সুবিবেচনার পরিচায়ক হবে না।
উপনির্বাচনগুলির ফলাফল থেকে জাতীয় রাজনীতি সম্বন্ধে আদৌ যদি কয়েকটি কথা বলা যায়, তা এই রকম— এক, ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার বস্তুটির প্রতি বিজেপির আস্থা যতখানি, ভোটারদের ততখানি নয়। দুই, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে, যেখানে বিজেপি-বিরোধী কোনও দলের পক্ষেই একক শক্তিতে (এবং, অন্যান্য বিরোধী দলের কারণে ভোট ভাগ হওয়ার ফলে) বিজেপির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মুশকিল, সেখানে জোটের উপরে ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। তিন, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে বিজেপির উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু তারা রাজ্যে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি নয়, সেখানে রাজ্যে ইন্ডিয়া জোটের বড় শরিককে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেওয়াই অন্য শরিকদের পক্ষে বিচক্ষণতার কাজ হবে। এই রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের ভূমিকা সহায়ক হওয়াই বিধেয়। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্যে, যেখানে কংগ্রেসের রাজনৈতিক উপস্থিতি তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বলে দেবে, গোটা দেশে জোটের ছবিটি ঠিক কেমন হতে চলেছে।