—প্রতীকী ছবি।
নিয়মহারা হিসাবহীন-এর কবিতার শতবর্ষেও বলতেই হয়, সব ক্ষেত্রে এই মন্ত্র মানতে গেলে কিন্তু বিশাল বিপুল গভীর গহন সঙ্কটে পড়তে হবে। সম্প্রতি আবারও এমন সঙ্কট নজরে এল। দেখা গেল, এই রাজ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের জন্যই, যাঁরা শিক্ষা দান করেন, তাঁদের জন্য নয়। পশ্চিমবঙ্গে সরকারপোষিত স্কুলগুলির শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে নিয়মিত ভাবে সময়ে না-আসার প্রবণতাটি লক্ষণীয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সরকারপোষিত স্কুলের শিক্ষকদের উপস্থিতি সংক্রান্ত নিয়মবিধি মেনে চলার বিষয়টিতে জোর দিয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে জারি হওয়া বিজ্ঞপ্তিতে যা বলা হয়েছে, তার মর্মার্থ— প্রার্থনা, সভা, উপস্থিতি প্রভৃতি বিষয়ে নিয়ম না মেনে চলার কারণে বিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
কথাটি অস্বীকারের উপায় নেই। এই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্দশা ব্যাখ্যায় সচরাচর প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রসঙ্গটিই আলোচিত হয়। সেই ব্যর্থতা সীমাহীন, নিঃসন্দেহে। কিন্তু এটাও সত্য, বিদ্যালয় শিক্ষার মূল দায়িত্বটি যাঁদের উপর, সেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, এবং শিক্ষকদের একাংশও সর্বদা নিজ কর্তব্যটি যথাযথ পালন করেন না। শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ বিষয়ে উদাসীনতা এই ক্ষেত্রেও পুরোমাত্রায় বর্তমান। তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ে সময়ে না আসা, সময়ের আগেই বেরিয়ে যাওয়া, শ্রেণিকক্ষের পড়ানোয় যথেষ্ট গুরুত্বদান না করার অভিযোগগুলি দীর্ঘ দিনের। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই বছরের জানুয়ারিতে পর্ষদ আরও এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, সমস্ত সরকারি এবং সরকারপোষিত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে হবে সকাল ১০টা ৩৫-এর মধ্যে, অন্যথায় হাজিরা খাতায় ‘লেট’ লেখা হবে। পর্ষদের নিয়মানুযায়ী, সরকারি এবং সরকারপোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীদের সকালের প্রার্থনাসভায় যোগদান বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে সেখানে শিক্ষকদের উপস্থিতি সামান্যই। কেবল তা-ই নয়, অনেকেই ক্লাসের নির্ধারিত সময়েও বিদ্যালয়ে আসেন না। প্রসঙ্গত, শিক্ষা দফতরের নির্দেশ— সরকারি, সরকারপোষিত ও মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকারা গৃহশিক্ষকতা করতে পারবেন না। তৎসত্ত্বেও এই চর্চা বন্ধ হয়নি। আবার, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের অনেকেই বিভিন্ন কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকায় পঠনপাঠন নিয়মিত অবহেলিত হয়।
এই অবহেলার পরিণাম মর্মান্তিক। এ রাজ্যে যে দ্রুততায় সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অধঃপতন পরিলক্ষিত হচ্ছে, এবং তাকে শোধরানোর ক্ষেত্রে সর্বস্তরে যে বিপুল উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে, তাতে আগামী দিনে অশিক্ষার হার কত বিপুল হবে, ভাবলেও ত্রাসের শিহরন হয়। তার উপর নানা অছিলায় বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া চলছেই: নির্বাচনী বছরে কয়েক মাসব্যাপী কর্মকাণ্ড, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর গ্রীষ্মাবকাশ, তুচ্ছ কারণে ছুটি দেওয়া। এর মাঝে প্রকৃত শিক্ষাদিবস পড়ে থাকে কতটুকু? তদুপরি শিক্ষকরাও যদি তাঁদের কাজে যত্নশীল না হন, তবে শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়? এ রাজ্যে প্রতি বছর আট-নয় লক্ষ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে। অর্থাৎ এক বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী এখনও সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার উপরেই ভরসা রাখে। এদের শিক্ষা যথাযথ না হলে তা রাজ্যের সার্বিক অগ্রগতিকে রুখে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।