—প্রতীকী ছবি।
শঙ্খ হুলাহুলি সানাই নিঃস্বন/ কর্তাল ঝঙ্কার অস্ত্রের ঝনন,” সুকুমার রায় লিখেছিলেন কৌতুক-নাটিকায়। তবে তা ছিল রাবণের আগমনবার্তা, হাসির আড়ালেও সেখানে এই বোধ রক্ষিত ছিল যে অস্ত্রের আস্ফালন রাবণকে মানায়, রামকে নয়। রামনবমীর পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এলে তিনি কী লিখতেন জানা নেই, তবে রামের নামে তরোয়াল পিস্তল হকি স্টিক দা কুড়ুল লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়া ‘শোভাযাত্রা’য় কৌতুক মুছে উদ্বেগ ও আতঙ্কই যে এখন সাধারণ মানুষের সঙ্গী, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনও। গত কয়েক বছর ধরে এটাই পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবচিত্র: রামনবমীর আগে তৃণমূল ও বিজেপির শাসানি ও হুমকি; ওর ‘পরিকল্পিত’ সংঘর্ষের ফাঁদে পা না দিতে এর চেতাবনি, এর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যর্থতা তুলে ধরে ওর তর্জন, এবং আসল দিনটিতে সশস্ত্র উগ্রতার জয়জয়কার। ক্যালেন্ডারের কোণে পড়ে থাকা একটি দিন, কয়েক বছর আগে পর্যন্তও আলাদা করে যার খোঁজ পড়ত না, সে-ই এখন রাজনীতির অস্ত্র: আলঙ্কারিক ও আক্ষরিক দুই অর্থেই। নয়তো আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে সশস্ত্র রামভক্তদের ধুন্ধুমার, আগ্নেয়াস্ত্রের ঝলকানি এমনকি নাবালকদের অস্ত্র হাতে মিছিলে শামিল করানো— কোনও কিছুই বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য নয়, কোনও দিন ছিল না। এ বছরও কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি সেই ছবির, শুধু লোকসভা নির্বাচনের নিয়মশৃঙ্খলার কড়াকড়ির আবহে হিংসার ঘটনা কম, এই যা। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অপ্রতিহত গতি যে ভাবে জনসমাজকে অসহিষ্ণুতায় ধারালো করে তুলেছে, তারই অব্যর্থ প্রকাশ এই অস্ত্র-ঝনঝনানির বাস্তবে।
এক দল যে অস্ত্র হাতে তুলবে, অন্য দল রুখতে চাইবে তার ধার-ভার, রাজনীতির চিরাচরিত নিয়ম। কিন্তু প্রবল অবিশ্বাস ও ততোধিক শঙ্কা জাগে যদি দেখা যায় বিরোধীর হাতের অস্ত্রকে ছুড়ে না ফেলে বরং হাতে তুলে নিয়েছে শাসক দলও। পশ্চিমবঙ্গে এ বছর রামনবমীতেও ঠিক তা-ই দেখা গেল। সিঁদুরে মেঘটি দেখা দিয়েছিল রামনবমীর দিন রাজ্য সরকারের ছুটি ঘোষণাতেই, এর আগে যা কখনও হয়নি— অফিসকাছারি কাজকর্ম বন্ধ করে, ছুটির দিনে রামনবমীর মিছিলের অবাধ বিস্তার দিতেই কি? বিস্ময়ের আরও কিছু বাকি ছিল, রামনবমীর দিন দেখা গেল শাসক দলের আয়োজনেই রামনবমীর শোভাযাত্রার অবাধ বিস্তার, এবং সেখানে তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের ভক্তিগদগদ রূপ: কোথাও প্রার্থী নেতা হাঁটছেন পাগড়ি-উত্তরীয় পরে, কোথাও বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গেই একই মিছিলে হাঁটছেন তৃণমূল নেতা! শাসক দলের সমাজমাধ্যমে ছড়ানো রামনবমীর বার্তায় লেখা হল ‘আমি এক জন রামভক্ত’, স্থানীয় নেতার ছবির সঙ্গে সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। সর্বোপরি, শাসক দলের তারকা প্রার্থীর মুখে শোনা গেল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি! তাঁর যুক্তিটি লক্ষণীয়: রামচন্দ্র তো বিজেপির ঝান্ডা হাতে জন্মাননি, সুতরাং ওই ধ্বনি তথা স্লোগানটিও একা বিজেপির হতে যাবে কোন দুঃখে!
এ-হেন কাজে রাজ্যের শাসক দল বা তার কর্ণধারের অদ্যাবধি আপত্তি শোনা যায়নি। মৌন সম্মতির লক্ষণ, তবে পশ্চিমবঙ্গে এ বছরের রামনবমী আরও বড় একটি লক্ষণ প্রকট করল: রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে বিরোধীর মত-পথকেও আত্তীকরণের লক্ষণ, বিরোধীর অস্ত্রকে শাসকেরও হাতে তুলে নেওয়ার লক্ষণ। রাজনীতির অঙ্গনে এ-হেন কাণ্ড অভাবিত বা অঘটনীয় নয়, নানা দেশে নানা কালে শাসক ও বিরোধীর ‘অস্ত্র’-এর হস্তান্তর ঘটেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ও বিশেষ করে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রাখলে এই হাতবদল অত্যন্ত আশঙ্কার, কারণ অস্ত্রটি এখানে প্রতিযোগিতামূলক ধর্মীয় রাজনীতির। রামনবমীতে কাদের কোন ‘শিক্ষা’ দিতে বিজেপির এই সশস্ত্র আস্ফালন তা সবার জানা। উল্টো দিকে তৃণমূল কংগ্রেসও সেই ‘বীরত্ব’-এর প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছে। নীতিভ্রংশের ষোলো কলাটি পূর্ণ হল।