—প্রতীকী ছবি।
সবার উপরে আসনসংখ্যা সত্য? জয়লাভের জন্য কোনও প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা অন্য প্রার্থীদের চেয়ে বেশি হওয়াই যথেষ্ট— কত বেশি, সে প্রশ্ন ফলাফলের ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন। কিন্তু, রাজনীতির ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব আছে। পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের ফল যেমন— আপাতদৃষ্টিতে বিজেপির জন্য হতাশাব্যঞ্জক, কিন্তু গত নির্বাচনের তুলনায় আসনসংখ্যা কমলেও ভোটপ্রাপ্তির হিসাবে বিজেপির আশাবাদী হওয়ার কারণ রয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায় এ বার বিজেপির ভোটপ্রাপ্তির অনুপাত সামান্য হলেও বেড়েছে। ২০২১ সালে বিজেপির প্রাপ্ত আসনসংখ্যা ৭৭ থেকে বেড়ে এই নির্বাচনে দলের ‘লিড’ রয়েছে ৯০টি বিধানসভা ক্ষেত্রে। যার মধ্যে এমন ১৯টি ক্ষেত্র রয়েছে, যাতে ২০২১ সালের নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছিলেন। বিজেপির ভোটপ্রাপ্তির কিছু ‘পকেট’ রয়েছে। যেমন, উত্তরবঙ্গে দলের ফলাফল ২০২১ সালের তুলনায় ভাল। রাজ্যের শহরাঞ্চলগুলিতেও বিজেপির ফলাফল ভাল। পূর্ব মেদিনীপুরের দু’টি লোকসভা কেন্দ্র তমলুক ও কাঁথির অন্তর্গত ১৪টি বিধানসভা ক্ষেত্রের মধ্যে ১৩টিতেই এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। তবে, গত লোকসভা নির্বাচনের সময় শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল কংগ্রেসে থাকাকালীন এই লোকসভা কেন্দ্র দু’টিতে তৃণমূল প্রার্থী যত ভোটে জয়ী হয়েছিলেন, এই দফায় জয়ের ব্যবধান তার তুলনায় অনেকখানি কম। বেশ কয়েকটি সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত আসনেও ‘লিড’ পেয়েছে বিজেপি। ফলে, এই লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ‘ভরাডুবি’ হয়েছে, সে কথা বলার উপায় নেই।
অন্য দিকে, আসনসংখ্যার নিরিখে তৃণমূল কংগ্রেসকে যতখানি অগ্রসর বোধ হচ্ছিল, ভোটের হিসাব সেই দলকে তার থেকে পিছিয়ে রাখছে। দলের শক্ত ঘাঁটি দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু আসনে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি তাদের উদ্বেগে রাখবে। নির্বাচনপর্বে বিশ্লেষকদের মত ছিল, সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ তৃণমূলের ঝুলিতে আসবে। বড়ঞা, জঙ্গিপুর বা তেহট্টের মতো সংখ্যালঘু-প্রধান বিধানসভা ক্ষেত্রে বিজেপির এগিয়ে থাকা ইঙ্গিত দিচ্ছে, যে সব কেন্দ্রে বিজেপি-বিরোধী অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের তাৎপর্যপূর্ণ শক্তি রয়েছে, সেখানে ভোট ভাগ হয়েছে। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে জোট বা আসন সমঝোতার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। মহিলা ভোটের একটা বড় অংশ তৃণমূলের দিকে আসা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। তবে, তারও যে একটি ঊর্ধ্বসীমা রয়েছে, সে কথা ভুলে যাওয়া যায় না।
এই নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী হাওয়া নিঃসন্দেহে ছিল। কিন্তু, সেটাই একমাত্র চালিকাশক্তি ছিল না। অনুমান করা চলে, এ রাজ্যে ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি’ প্রবণতাটি যতখানি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি কাজ করেছে রাজ্যের শাসকদের বিরুদ্ধে। তার পরও তৃণমূল কংগ্রেস বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় আসনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক বিধানসভা ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে, তার অন্যতম কারণ হল রাজ্যস্তরে দলের মজবুত সংগঠন। লক্ষণীয়, যে সব বিধানসভা ক্ষেত্রে তৃণমূলের সংগঠন তুলনায় দুর্বল, সেগুলির সিংহভাগেই এগিয়ে রয়েছেন বিজেপি প্রার্থী; অঞ্চলবিশেষে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থীও। রাজ্যের শাসকদের প্রতি মানুষের ক্ষোভের একটি বড় কারণ দুর্নীতি। ২৯টি আসনে জয়ী হওয়ায় যদি তাঁরা ধরে নেন যে, সর্বব্যাপী দুর্নীতি মানুষের মনে তেমন ছাপ ফেলে না, তা হলে তা মস্ত ভুল হবে। ভোটের অঙ্কের বিশ্লেষণ বলছে, সব গোষ্ঠীগত হিসাবনিকাশের পরেও সুশাসনের প্রতি মানুষের চাহিদা প্রবল। ঠিক যেমন অর্থনৈতিক উন্নতি ও সামগ্রিক প্রশাসনের নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করে মানুষ। শাসক দল যদি সে চাহিদাকে স্বীকার না করে, অথবা তা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তার ফলাফল কী হবে, সে প্রশ্নের উত্তর ২০২৬ সালেই মিলতে পারে।