ডেনমার্কের সেই ‘নোমা’ দরজা বন্ধ করতে চলেছে। ছবি: সংগৃহীত।
বিশ্বের সেরা রেস্তরাঁর তালিকায় সর্বোচ্চ স্থানটি যার দখলে, ডেনমার্কের সেই ‘নোমা’ দরজা বন্ধ করতে চলেছে। বিক্রি পড়ে যায়নি, বরং তার উল্টোটাই— প্রতীক্ষা-তালিকায় থাকা লোকেদের পালা শেষ করতেই বছর ঘুরে যাবে। কোপেনহাগেন-এর কাছে একটি দ্বীপে গড়ে-ওঠা এই রেস্তরাঁর খাবার যেমন বিখ্যাত, তেমনই খাদ্যদর্শনটিও— ‘স্থানীয়ই সেরা’। তাদের অধিকাংশ উপাদান আসে ঘরের পাশের সমুদ্র আর অরণ্য থেকে। নানা উদ্ভাবনী উপায়ে, বহু যত্ন আর পরিশ্রমে তৈরি করে পাতে দেওয়া হয় গ্রিল-করা বল্গাহরিণের হৃৎপিণ্ড, কিংবা সামুদ্রিক গুল্ম দিয়ে কড মাছের মাথা। খাবার সম্পর্কে অভ্যস্ত প্রত্যাশাকে ভেঙেচুরে নতুন করে গঠন করার এই রীতি বিশ্বের সেরা রেস্তরাঁগুলিকে প্রভাবিত করেছে। তিনখানা ‘মিশেলিন স্টার’— রেস্তরাঁ শিল্পের জগতে যাকে অস্কার বলা চলে নিঃসন্দেহে— যার কব্জায়, এত যার জনপ্রিয়তা, ২০২৪ সালে কেন বন্ধ হবে সেই রেস্তরাঁ? মুখ্য রন্ধনশিল্পী বা ‘শেফ’ রেনি রেডজ়পাই জানিয়েছেন, তার কারণ, অত্যুৎকৃষ্ট উপাদান আর অতিপরিশীলিত সৃষ্টিশক্তি দিয়ে সেরা মানের খাবার তৈরি করতে যত পরিশ্রম করেন কর্মীরা, সেই অনুসারে পারিশ্রমিক তাঁদের দেওয়া যাচ্ছে না। অতিধনীদের জন্য অতিদামি খাবার বিক্রি করেও শ্রমের উপযুক্ত বেতন উঠছে না। এই সঙ্কট ‘ফাইন ডাইনিং’ বা বিলাসী ভোজনের দুনিয়ায় প্রায় সর্বত্র। ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত শেফ কিম মিকোলা সম্প্রতি বলেছেন যে, মহার্ঘ হিরের মতো, ‘ফাইন ডাইনিং’-এর অন্তস্তলেও রয়েছে পীড়নের অন্ধকার। কর্মীদের যথেষ্ট পারিশ্রমিক না দেওয়া, শিক্ষানবিশদের নিখরচায় খাটানো, নানা অভিযোগ উঠেছে।
এক দিকে উৎকর্ষের শিখর, অন্য দিকে অন্যায়ের খাদ— কিছু দিন আগে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরেও এমনই দেখা গিয়েছিল। কাতার যেন ময়দানবের জাদুতে গড়ে তুলেছিল নতুন নতুন স্টেডিয়াম, এয়ারপোর্ট, হোটেল। সেই সব সৌধের নীচেই মিলল দাসপ্রথার পচা পাঁক— কাতারে কর্মরত মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রমিকদের অমানবিক দশা, অসহায় মৃত্যু। এ দেশেও দোরগোড়ায় খাবার পৌঁছে দেওয়ার অ্যাপ যত জনপ্রিয় হয়েছে, ততই প্রশ্ন উঠেছে ‘ডেলিভারি’ কর্মীদের পারিশ্রমিক নিয়ে। বিক্ষোভের সংবাদে উঠে আসে, অর্ধভুক্ত অবস্থায় কর্মীরা পিঠে দামি খাবারের বোঝা পৌঁছে দেন ঘরে ঘরে, সারা দিন। মনে পড়ে ষষ্ঠ শতাব্দীর পোপ গ্রেগরির কথা, যিনি সাতটি ভয়ানক পাপের তত্ত্ব ফেঁদেছিলেন, যার অন্যতম অতিভোজন (গ্লাটনি)। তাঁর মতে, অতিভোজন কেবল অতিলোলুপতা নয়। অতিরিক্ত দামি, অতিরিক্ত পরিশীলিত খাবার খাওয়াও অতিভোজনের মধ্যে পড়ে। তারও অনেক আগে, মহাকাব্যে বর্ণিত এক রাজপুত্র দিনান্তে শাকান্নভোজীকে ‘সুখী’ বলেছিলেন। পোলাও-মাংসকে সুখের শর্ত করেননি যুধিষ্ঠির। মহাভারত সমতাকে সত্যের সমান মর্যাদা দিয়েছে। এক জনের বাড়াবাড়ি— তা সে মানেই হোক বা পরিমাণে— অন্যকে বিপন্ন করবেই। এক নাগরিক কবিয়াল দাবি করেছিলেন, কেউ যদি বেশি খায়, তাকে খাওয়ার হিসাব দিতে হবে, ‘কেননা অনেক লোক ভাল করে খায় না’।
সুখাদ্যপ্রেমীরা বলবেন, ভালমন্দ না খেয়ে স্রেফ শাকভাত চিবিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়াই হল সবচেয়ে বড় অন্যায়। অনেকের কাছে অবশ্য পরিচিত খাবারটিই সেরা খাবার। এ দেশে পাইস হোটেল থেকে পাঁচতারা হোটেল— সকলেই অতীতকে প্লেটে টেনে আনার দাবি করে, তা সে নবাবি কাবাব হোক, অথবা দিদিমার বাটিচচ্চড়ি। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, বিলাসবহুল রেস্তরাঁয় কি রসনাতৃপ্তিই প্রাধান্য পায়, না অন্য কিছু? একগাদা টাকা নিয়ে শেফ টেবিলে পাঠান অতিসামান্য কিছু আহার্য। তাতে হয়তো রয়েছে বিরল গুগলি কিংবা দুষ্প্রাপ্য ছত্রাক, প্লেট-সাজানোর বাহার দেখে জিভের চাইতে ভুরু নাচে বেশি। কিন্তু রসনাতৃপ্তির সঙ্গে বিমূর্ত শিল্প দর্শন, বা প্রকৃতি-পর্যটন যে খাপ খাবেই, তেমনটা কি ধরে নেওয়া যায়? হলিউডের ছবি দ্য মেনু-তে এই প্রশ্নটিই উঠেছে। এক তারকা শেফ বিচিত্র, বাহারি নানা পদ পরিবেশন এবং তার বিশদ ব্যাখ্যা করার পরে একটি মেয়ে প্রশ্ন তোলে, এ কি মিউজ়িয়াম না রেস্তরাঁ? খেয়ে মন ভরে যায়, এমন খাবার কোথায়? পাশ্চাত্যে খাদ্যবিলাস এত দিন অত্যুৎকৃষ্ট খাবারের যে ধরন নিয়ে মাতামাতি করছিল, এ বার তাতে ভাটা পড়ছে। দারুণ খাবার মানে কেমন খাবার, সে প্রশ্ন নিয়ে আলোড়ন চলছে।