সুপ্রিম কোর্ট।
ভারতের বিচারব্যবস্থাকে নিয়ে গর্ববোধ করার কারণ যে বিলক্ষণ আছে, গর্ভপাত প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই কথাটিকে আরও এক বার প্রমাণ করল। বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বোপান্না ও পার্দিওয়ালার বেঞ্চ দিল্লি হাই কোর্টের একটি রায়কে খারিজ করে জানাল যে, গর্ভপাতের প্রসঙ্গে বিবাহিত ও অবিবাহিত মহিলার মধ্যে আইন কোনও ফারাক করতে পারে না— সম্মতিক্রমে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈবাহিক অবস্থার বিচার করা হলে তা ‘অসাংবিধানিক’ হবে। কথাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভপাত সংক্রান্ত আইনের ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের উদারতর দেশগুলির তালিকাভুক্ত— ১৯৭১ সাল থেকেই এই দেশে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ। বর্তমান মামলাটি ছিল একটি বিশেষ প্রশ্নকে ঘিরে— মেডিক্যাল টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সি আইনের ৩(খ) ধারায় কি কোনও অবিবাহিত মহিলা বিবাহবন্ধনের বাইরে সম্মতিক্রমে ঘটা যৌন সম্পর্কের ফলে সৃষ্ট গর্ভ ২০-২৪ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত করাতে পারেন? সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ শুধু সম্মতিই জানায়নি, একই সঙ্গে বলেছে যে, গর্ভ সংক্রান্ত অধিকারের সিদ্ধান্ত মহিলাদের— তার সঙ্গে বৈবাহিক অবস্থার সম্পর্ক নেই। আদালত জানিয়েছে, যেখানে অন্য বর্গভুক্ত মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার রয়েছে, সেখানে অবিবাহিত মহিলাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোনও ভিত্তি নেই।
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের তাৎপর্য সুবিপুল। নারীর শরীরের উপর নারীর সম্পূর্ণ অধিকার স্বীকার করা তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নারী যে গর্ভধারণের যন্ত্রমাত্র নন, তাঁর নিজের শরীরের উপর তাঁর অধিকার সার্বভৌম এবং প্রশ্নাতীত, এই কথাটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যত বার উচ্চারণ করা যায়, ততই ভাল। কেবলমাত্র ধর্ষণ নয়, সম্মতিক্রমে ঘটা যৌন সম্পর্কের ফলে সন্তানসম্ভবা হলেও গর্ভপাতের অধিকারকে স্বীকার করে ভারতীয় আইন ইতিমধ্যেই উদারবাদী ‘প্রো-চয়েস’ অবস্থানের পক্ষপাতী। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট যেমন উল্টো পথে হেঁটেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের শীর্ষ আদালতের অবস্থানকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। এই ক্ষেত্রে বিবাহিত এবং অবিবাহিত মহিলার মধ্যে ফারাককে ‘অসাংবিধানিক’ বলে চিহ্নিত করে সুপ্রিম কোর্ট যৌনতার ক্ষেত্রেও নারীর ‘অটোনমি’কে প্রশ্নাতীত বলে স্বীকৃতি দিল। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে যে, এমটিপি আইনের ৩(খ) (গ) ধারাটিকে যদি শুধুমাত্র বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলেই ধরা হয়, তা হলে ধরে নিতে হয় যে, শুধুমাত্র বিবাহিত মহিলারাই যৌনতা করেন। এই কথাটি সাংবিধানিক নয়। অর্থাৎ, আদালতের রায়টিকে যৌনতার অধিকারের স্বীকৃতি হিসাবেও পাঠ করা সম্ভব এবং বিধেয়। এই অধিকার আধুনিক সময়ের দাবি— বিবাহ, যৌনতা ও সন্তানধারণ, এই তিনটির মধ্যে সম্পর্ককে অপরিহার্য বলে গণ্য করলে সময়ের চাহিদার থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে হয়। সুপ্রিম কোর্টের রায়টি সামাজিক উদারতার পক্ষে।
এই রায়ে শীর্ষ আদালত জানিয়েছে যে, বৈবাহিক সম্পর্কেও স্বামীর দ্বারা নিগ্রহের ফলে গর্ভসঞ্চার হলে এমটিপি আইনে তাকে ধর্ষণ হিসাবেই গণ্য করা হবে। এই সিদ্ধান্তটির তাৎপর্যও অপরিমেয়। স্ত্রী প্রাপ্তবয়স্ক হলে ভারতীয় আইনব্যবস্থা এখনও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-কে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে না। অন্তত গর্ভপাতের প্রসঙ্গে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-কে স্বীকার করে নেওয়ার অর্থ, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে নারীর আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে, এবং নিজের শরীরের উপর তাঁর প্রশ্নাতীত অধিকারকে স্বীকার করা। নারীর সম্মতি না থাকলে তাঁকে যে সন্তানধারণে বাধ্য করা যায় না, স্বামী বা পরিবার, কারও সেই অধিকার নেই, সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে এই বার্তাটি পড়ে নেওয়া প্রয়োজন। রাজনীতি এবং সমাজের বৃহদাংশ যখন মধ্যযুগের দিকে হাঁটতে চায়, তখন শীর্ষ আদালতের এই উদার অবস্থান গণতন্ত্রের পক্ষে অতি সুসংবাদ।