— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়— এ কথা ঠিক। তেমনই এটাও ঠিক, যে ভুল সচেতন ভাবে সর্বসমক্ষে করা হয়, সেটি আর নিছক ‘ভুল’ থাকে না। হয়ে দাঁড়ায় সত্যের অপলাপ, এবং তদর্থে নিন্দনীয়। সম্প্রতি বিজেপির দুই প্রার্থী দুই সাক্ষাৎকারে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নামটি ‘ভুল’ বলেছেন। প্রথম জন, হিমাচলের মণ্ডীর বিজেপি প্রার্থী অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত মন্তব্য করেছেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। অন্য জন, তামিলনাড়ুর কোয়ম্বত্তূরের বিজেপি প্রার্থীও প্রথম প্রধানমন্ত্রীর আসনটি দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধীকে। মনে রাখা প্রয়োজন, তাঁরা উভয়েই এ বার প্রার্থী। দেশের ইতিহাস সম্পর্কে যথাযোগ্য জ্ঞান অর্জন করে তবেই প্রার্থীরা প্রচারকাজ চালাবেন, এমনটাই অভিপ্রেত। অথচ, যে জ্ঞান সাধারণ ভাবে এক জন প্রাথমিক শিক্ষার্থীরও থাকে, সেই জ্ঞানের পরিচয়ও যে তাঁরা রাখলেন না, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক।
শুধু লজ্জাজনক বললে অবশ্য ঘটনার অতিসরলীকরণ হয়— বিশেষত যেখানে ভারতের ইতিহাস বদলে দেওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা গত দশ বছরে চলেছে লাগাতার। ভিন্ন ধর্ম, বিরোধী মত, ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসীরা পাঠ্যবইয়ে নেই, বা এক কোণে টিমটিম করছেন, আর সমধর্মীদের কৃতিত্ব ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে, ব্রিটিশ সাহায্যকারীকে নায়কোচিত মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে— এমন উদাহরণ সুপ্রচুর। এর কোনওটিই আকস্মিক বা অকারণ নয়, প্রতিটি ‘প্রচেষ্টা’র পিছনেই ‘রাজনীতি’ উজ্জ্বল। নেতাজি ও গান্ধীজিকে নিয়ে সাম্প্রতিক ‘ভ্রান্তি’র ক্ষেত্রেও তাই। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু— যাঁর মতাদর্শ, নবগঠিত দেশ ও জাতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বিজেপির আক্রমণের লক্ষ্য। সুতরাং, স্বাধীন ভারতের প্রথম পর্যায়ে নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্ব-কালকে সেই দলেরই দুই উল্লেখযোগ্য প্রার্থীর সম্পূর্ণ বিস্মৃত হওয়া— এবং কঙ্গনার আলঙ্কারিক প্রশ্ন, প্রথম প্রধানমন্ত্রী সুভাষচন্দ্র কোথায় গেলেন?— এ সব কাকতালীয় নয়, ‘ভুল’ তো নয়ই। কঙ্গনার পরবর্তী দাবি, আজ়াদ হিন্দ সরকার গঠন প্রসঙ্গে তিনি এই মন্তব্য করেছেন, সেটাও যে ক্ষতি মেরামতির চেষ্টা, তাতে সন্দেহ নেই।
নেতাজিকে নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিজেপি নেতারা সরব। এর আগেও নেতাজিকে ভারতের ‘অলিখিত প্রধানমন্ত্রী’ বলেছিলেন তাঁরা। তাঁর জন্মদিনটিকে ‘পরাক্রম দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী। এই আত্যন্তিক নেতাজি-প্রীতির মূল কারণটি, তাঁদের দৃষ্টিতে, নেহরুর সঙ্গে নেতাজির মতপার্থক্য। অথচ এই দুই নেতার মধ্যে মতপার্থক্য কোনও কালেই শত্রুতায় পর্যবসিত হয়নি, এমনকি বিশেষ অমিত্রতাও তৈরি হয়নি। বিভেদের রাজনীতিতে দক্ষ বিজেপি নেতৃবৃন্দ কেবল দ্বৈরথের চিহ্নগুলি তুলে ধরছেন, এবং তার অতিরঞ্জন করে চলেছেন। বিজেপিকে স্মরণ করানো প্রয়োজন, যে বিভেদের রাজনীতিতে তাঁদের বিশ্বাস, নেতাজি চিরজীবন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তার বিরোধিতা করেছেন। ১৯৪০ সালে এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তাঁর বক্তৃতা, যেখানে তিনি বলেন— “ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে।... এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনার রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন।” বিজেপির সঙ্গে তাঁর মতাদর্শগত তফাতটি অসেতুসম্ভব— বিজেপি নেতারা বৃথাই সেতু বাঁধার চেষ্টা করে চলেছেন।