ফাইল চিত্র।
শিক্ষকদের ক্ষোভ গড়াইল আদালতে। ভোটের কাজ হইতে অব্যাহতি চাহিয়া কলিকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হইলেন সরকার-পোষিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল ও মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একটি বৃহৎ সংগঠন। সংগঠনের বক্তব্য, উক্ত পদ ‘সিঙ্গল কাডার পোস্ট’, পঠনপাঠনের সহিত বিদ্যালয়ের প্রশাসনও তাঁহাদেরই সামলাইতে হয়। তাঁহাদের তত্ত্বাবধানেই নিষ্পন্ন হয় কল্যাণমূলক প্রকল্পসমূহ। স্কুল ফেলিয়া তাঁহারা অন্যত্র গেলে বিদ্যাঙ্গন চলিবে কী প্রকারে? প্রশ্নটি অবশ্য শুধু এই বৎসরের নহে। প্রতি বারই ভোটের কাজে স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রেরণ করিবার সময় একটি মৌলিক প্রশ্নের সম্মুখীন হইতে হয়— তাঁহারা গড়পড়তা সরকারি কর্মচারী নহেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রস্তুত করিবার গুরুদায়িত্ব তাঁহাদের উপর ন্যস্ত। ভোটের কাজে তাঁহারা দীর্ঘ সময় বিদ্যালয় হইতে দূরে থাকিলে কি পঠনপাঠনের শৃঙ্খলার অনপনেয় ক্ষতি হয় না? প্রশ্নটির গুরুত্ব অস্বীকার করিবার কোনও অবকাশ নাই।
অতিমারির প্রেক্ষিতে প্রশ্নটি জটিলতর হইয়াছে। প্রায় বৎসরকাল বাদে, বিগত ১২ ফেব্রুয়ারি শেষাবধি স্কুল খুলিয়াছে। কাজটি সহজ ছিল না— বহু বৈঠক, পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনার বাধা পার করিয়া পুনরায় কিছু অংশের পঠনপাঠন শুরু হইয়াছে। এখনও বিঘ্নের অন্ত নাই, ক্লাসঘরে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখিতে গিয়া কালঘাম ছুটিতেছে, কাহারও সংক্রমণের উপসর্গ মিলিতেই বিদ্যালয় বন্ধ হইতেছে। এমতাবস্থায়, প্রধান শিক্ষকদের মাসাধিক কাল ভোটের কাজে ব্যাপৃত করিয়া দিলে বিদ্যালয়গুলি শুধু অব্যবস্থার চাপেই অচল হইয়া পড়িতে পারে। এই মুহূর্তে বিদ্যালয়গুলির সর্বাধিক মনোযোগ প্রাপ্য। তাহার ছন্দে ফিরিবার প্রক্রিয়াটি বাধাপ্রাপ্ত হইতে পারে, এমন কোনও সিদ্ধান্তই করা অনুচিত হইবে। কেহ বলিতে পারেন, এই মুহূর্তে শিক্ষাব্যবস্থাকে ছন্দে ফিরাইয়া আনিবার কাজটিকে আপৎকালীন পরিষেবা হিসাবে গণ্য করাই বিধেয়। কারণ, ভারতে আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে ইতিপূর্বে কখনও গোটা ব্যবস্থা স্তব্ধ হইয়া যায় নাই, গোটা ব্যবস্থাকে ফের জঙ্গম করিবার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হয় নাই সরকারকে। খেদের বিষয়, শিক্ষার পরিকাঠামো যে শিক্ষার নিমিত্ত ব্যবহৃত হওয়াই সর্বাধিক জরুরি, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এই সহজ সত্যটির প্রতিফলন দেখা যায় না।
যদিও ইহা স্বীকার করিতে হয় যে, নির্বাচন কমিশনের সম্মুখেও এক্ষণে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় ঘনবসতিপূর্ণ, বিচিত্র ও রাজনৈতিক হিংসাদীর্ণ রাজ্যে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা এমনিতেই দুরূহ দায়িত্ব, আর ২০২১ সালে অতিমারির কারণে কাঠিন্যের মাত্রাটি অত্যধিক। বর্তমান সঙ্কটের কথা মাথায় রাখিয়া শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখিতে ভোটকেন্দ্র বাড়িয়াছে, অতএব কর্মী-সংখ্যাও। দায়িত্ব তাই প্রশানকেই লইতে হইবে। এক পক্ষে, এক বৎসরের নিষ্ক্রিয়তার পরে শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যতের দিকে নজর দেওয়া; অপর পক্ষে, ভোটারদের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত করা। এবং, দুইটিই স্বাস্থ্যবিধির বিবেচনায়। এই কাজে ভ্রান্তি হইলেও— যে অভিযোগ লইয়া আদালতে গিয়াছেন শিক্ষকেরা— ক্রমাগত ভারসাম্যের হিসাব কষিয়া যাইতে হইবে। ভারসাম্যটি পরিকল্পনার ও কার্যনির্বাহের। আপৎকালে ইহা অপেক্ষা জরুরি দায়িত্ব কিছু নাই।