রাহুল গান্ধী। ছবি: পিটিআই।
সুরাতের আদালতে রাহুল গান্ধী বৃহস্পতিবার মানহানির মামলায় দণ্ডিত হলেন, শুক্রবার তাঁর সাংসদের আসন খারিজ করার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে গেল। দিল্লীশ্বরদের এই অলোকসামান্য তৎপরতায় ভক্ত প্রজা মুগ্ধ হয়ে জয়ধ্বনি দেবেন, ভক্তিরসে বঞ্চিত নাগরিক বিস্ফারিতনয়নে বলবেন ‘কী দাপট!’ আর অশ্বত্থের ডালে বসে পেঁচা তার চোখ পাল্টে ঘোষণা করবে তুমুল গাঢ় সমাচার: ধরা যাক দু-একটা বিরোধী এ বার। কার মান কোথায় থাকে, কখন কোন কথায় সেই মানের হানি হয়, দেবা ন জানন্তি। প্রায় চার দশক আগে রাজীব গান্ধীর নামে যে প্রচার গলিতে গলিতে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, কিংবা সাম্প্রতিক কালে শাসক দলের নেতাদের শ্রীমুখে প্রতিপক্ষের সম্পর্কে যে সুভাষিতাবলি শোনা গিয়েছে, সেগুলির ক্ষেত্রে ইতিহাস কেন ভিন্ন পথের পথিক— সেই সব রহস্যের তল পাওয়া কঠিন। তবে কিনা, বিচারব্যবস্থার নিয়মে এক আদালতের রায়ের উপর উচ্চতর আদালতে আপিল করা যায়। সুরাতের আদালতও সেই সব প্রক্রিয়া সাপেক্ষেই রাহুল গান্ধীর দণ্ডাদেশ কার্যকর করবার আগে এক মাস সময় দিয়েছে। এখনই তাঁর মুখের উপর সংসদের দরজা বন্ধ করার কোনও বাধ্যবাধকতা তো ছিলই না, ‘স্বাভাবিক’ যুক্তিও ছিল না। কিন্তু মহাশক্তিধর কার্যনির্বাহকদের বোধ করি অ-সম্ভব তাড়া ছিল।
এই তাড়া রাজনীতির। উগ্র, অসহিষ্ণু রাজনীতির। তার অভিধানে সহিষ্ণুতা কেবল অনুপস্থিত নয়, বর্জিত। বর্তমান শাসকরা সহনশীলতাকে দুর্বলতা বলেই গণ্য করেন, যে কোনও বিরোধিতার স্বরকে দমন করাই তাঁদের কাছে শৌর্যের একমাত্র অর্থ। রাহুল গান্ধীর বিরোধী স্বরটি কেবল প্রবল নয়, ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট, শনিবারের সাংবাদিক সম্মেলনেও সেই ধারা অব্যাহত। দীর্ঘ দিন ধরে সংসদের ভিতরে এবং বাইরে, জনসমাবেশ থেকে শুরু করে দীর্ঘ ভারত জোড়ো অভিযানের যাত্রাপথে, তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারকে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, সমালোচনা করেছেন, কৈফিয়ত দাবি করেছেন। বিরোধী রাজনীতিকের এটাই কাজ। দেশের অনেক বিরোধী রাজনীতিকই সে-কাজ যথেষ্ট জোরের সঙ্গে পালন করছেন না, শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিবাদ প্রায়শই নানা কৌশলের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায়, তার স্বর থেকে থেকেই খাদে নেমে আসে অথবা স্তব্ধ হয়। রাহুল গান্ধী সেই পরিসরে ব্যতিক্রম। তার ফলে সর্বভারতীয় জনপরিসরে বিরোধী নেতা হিসাবে তাঁর মর্যাদা ক্রমশ বাড়ছে। অতএব দিল্লীশ্বররা স্থির করেছেন, তাঁকে মাসুল গুনতে হবে। আদালতের রায় ঘোষণামাত্র তাঁরা মাসুল আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
কংগ্রেস অতঃপর কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে, বিচারবিভাগের সিদ্ধান্তই বা কোন দিকে যায়, সে-সব ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু বিরোধী দলগুলি কি এ বার দেওয়ালের লিখন পড়তে পারবে? ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সেটাই মুখ্য প্রশ্ন। প্রতাপ-অন্ধ শাসকের দাপট যখন এমন উৎকট হয়ে ওঠে, তখন গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসাবে বিরোধী শিবিরের সংহতির কোনও বিকল্প থাকে না। কিন্তু ‘জাতীয় রাজনীতি’র পরিসরে সেই সংহতি এ-যাবৎ অধরা। বিভিন্ন বিরোধী দল এবং গোষ্ঠী ক্ষুদ্র স্বার্থের তাড়নায় বা আতঙ্কের বশে নানা কূটকৌশলে ব্যস্ত থেকেছে। সেই ইতিহাস বদলাবে কি? পরিবর্তনের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বটে। এক দিকে, কার্যত সমস্ত বিরোধী দল রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজের প্রতিবাদ জানিয়েছে। অন্য দিকে, শুক্রবার সকালেই সুপ্রিম কোর্টে বিরোধীদের বিরুদ্ধে সিবিআই বা ইডি-র মতো কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলির ধারাবাহিক অপব্যবহারের অভিযোগ পেশ করেছে চোদ্দোটি বিরোধী দল, যাদের অনেকগুলিই সম্প্রতি একই অভিযোগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে লিখিত চিঠিতে শামিল হয়নি। দুঃশাসন সীমা ছাড়ালে প্রতিস্পর্ধী সংহতির সম্ভাবনা বাড়ে। তবে, আপাতত, সম্ভাবনামাত্র।