রাহুল গান্ধী। —ফাইল চিত্র।
ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নেতা যদি নিতান্ত কুনাট্য অবলোকনে আমোদ পান— এমনই আমোদ যে, তাকে ভিডিয়ো করে রাখতে উদ্যত হন, এবং তাঁর সেই উল্লসিত ভঙ্গিটি অন্য কেউ ভিডিয়ো করছেন কি না, সে দিকে হুঁশ থাকে না— তবে, সেই আচরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। রাহুল গান্ধীকে যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদী ভারতের পুনঃসম্ভাবনার প্রতীক হিসাবে কল্পনা করেছিলেন, তাঁদের দুঃখিত হওয়া স্বাভাবিক, ক্ষুব্ধ হওয়াও। প্রথমত, আইনসভা পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা যতই পক্ষপাতদুষ্ট হোক, জগদীপ ধনখড় দেশের উপরাষ্ট্রপতি— তাঁর শারীরিক ভঙ্গিমা নকল করে হাসিঠাট্টার মধ্যে যে ভয়ঙ্কর কুরুচি রয়েছে, তাকে এড়িয়ে যাওয়ার মতো রুচিবোধ ও পরিণতমনস্কতা রাহুল গান্ধীর কাছে প্রত্যাশিত ছিল। ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খোলার কথা বলেন যে নেতা, তাঁর পক্ষে এই কদর্যতায় যোগদান অক্ষমণীয়। আচরণটি যাঁরা করছিলেন, তাঁরা দেশের সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে জনপ্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত, এ কথা ভাবতেও লজ্জাবোধ হয়। কিন্তু, তাঁদের অন্তত একাংশের পূর্ব আচরণকে সাক্ষী মানলে বলতে হয়, এ-হেন লজ্জাকর আচরণ তাঁদের কাছে অপ্রত্যাশিত নয়। এমন সাংসদদের সমকক্ষ না হওয়ার মতো নৈতিক বিবেচনাবোধ রাহুলের কাছে প্রত্যাশিত ছিল।
নৈতিকতার কথা যদি বাদও দেওয়া যায়, রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান থাকলেও কেউ এই কাজটি করে না। কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের এই অসংযত আচরণকে বিজেপি যতখানি ব্যবহার করতে পারত, তাতে রাহুল গান্ধীর উপস্থিতি যে অস্ত্রটির ধার এবং ভার অনেকগুণ বাড়িয়ে দেবে, এ কথা বুঝতে রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না। রাহুল বিজেপির হাতে সেই অস্ত্র তুলে দিলেন, অবলীলায়। দেড়শো জন সাংসদকে কার্যত অকারণে বহিষ্কার করার ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তটির চেয়ে বড় হয়ে উঠল এই প্রশ্নটি; বেকারত্ব বা মূল্যবৃদ্ধির প্রশ্নগুলিও ধামাচাপা পড়ে গেল। ঘটনাটির উপর সম্প্রদায়গত রংও চাপানো হল— ব্যক্তি ধনখড় নয়, বিজেপি বলল যে, এই আক্রমণের লক্ষ্য আসলে সমগ্র জাঠ সম্প্রদায়। এমনটা যে ঘটতে পারে, তার প্রবল উদাহরণ অনতিঅতীতেই ছিল— রাহুল গান্ধী কতিপয় ‘মোদী’ পদবিধারীকে কটাক্ষ করেছিলেন, এবং বিজেপি তাকে একটি অনগ্রসর জাতির অপমান হিসাবে প্রচার করেছিল, যার জেরে রাহুল সাংসদ পদ অবধি খুইয়েছিলেন। কোনও রকম আগুন নিয়ে খেলতেই যে বিজেপির আপত্তি নেই, বরং সেই খেলার বিশেষ প্রতিভা রয়েছে, এ কথাটি না বোঝার কোনও কারণ থাকার কথা নয়। কেউ বরং এমন কথাও বলতে পারেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসের পোড়-খাওয়া সাংসদ এতশত না ভেবেই এমন একটি কাজ করবেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু রাহুল গান্ধী সেই ফাঁদে পা দিয়ে আমোদে আত্মহারা হবেন, তা ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়।
রাহুল গান্ধী কী করছেন, কেন করছেন, তা তিনি নিজেও জানেন কি না, সেই প্রশ্নটি করা প্রয়োজন। ২০১৩ সালে তিনি নিজের দলের সরকারেরই আনা অধ্যাদেশ লোকসভার ওয়েলে দাঁড়িয়ে ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আলিঙ্গন করে নিজের আসনে ফিরে চোখ টিপে অবোধ্য ইঙ্গিত করেছিলেন। দেশের বৃহত্তম বিরোধী রাজনৈতিক দলের সর্বোচ্চ নেতার আচরণকে ‘ছেলেমানুষি’ আখ্যা দিতে হলে তা অতি দুর্ভাগ্যের। ভারত জোড়ো যাত্রাকে অনেকেই রাহুলের রাজনৈতিক প্রাপ্তমনস্ক হয়ে ওঠার মুহূর্ত হিসাবে কল্পনা করেছিলেন। সেই যাত্রা মেটার পর যেমন তিনি তার রেশ নিজের রাজনীতিতে ধরে রাখার চেষ্টামাত্র করেননি, তেমনই এ দিন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আচরণ উপভোগ করে বুঝিয়ে দিলেন, প্রাপ্তমনস্কতা যে সাধনার ফল, সে তাঁর নয়। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যিনি নিজেই নিজেকে রাজনীতিক হিসাবে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন না, দেশের মানুষ তবে তাঁকে সেই গুরুত্ব দেবে কেন? তাঁকে ভরসা করবে কেন?