রাজনীতি সম্ভবত এক পরশপাথর, তবে বিপরীতার্থে— যা ছোঁয়, তাকেই মলিন করে তোলে; তার যাবতীয় সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করে অবশিষ্ট রাখে শুধু ক্লেদ। প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের মতো একটি নীতির ক্ষেত্রে ঠিক সেই ঘটনাটিই ঘটে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণটিই বিবেচনা করা যাক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ননীতিতে কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভান্ডার বা বিধবা ভাতার মতো প্রকল্পের উপস্থিতি অতি প্রকট। কেন, তা নিয়ে তিলমাত্র সংশয় নেই— ভোটের জন্য। তাঁরা জানেন, টাকার বিনিময়ে তাঁরা রাজ্যের জনসংখ্যার একটা বড় অংশের কৃতজ্ঞতা কিনতে পারবেন। বা, কৃতজ্ঞতা না হোক, অন্তত এটুকু ভয় তৈরি হবে যে, এই সরকার ক্ষমতায় না থাকলে হয়তো এই টাকাটুকু বন্ধ হয়ে যাবে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে যা ঘটে, শেষ পর্যন্ত সবই ভোটের জন্য। কাজেই রাজ্যের শাসক দলকে সে বিষয়ে আলাদা করে দোষী সাব্যস্ত করা অর্থহীন। কিন্তু, যখন কোনও রাখঢাক ছাড়াই নির্বাচনী দেওয়াললিখন জানায় যে, লক্ষ্মীর ভান্ডারে বরাদ্দ বেড়েছে অতএব তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দেওয়া বিধেয়— তখন প্রশ্ন জাগে, লেনদেনের এই কদর্যতায় উন্নয়ননীতির স্থান কোথায়? অন্য দিকে, রাজকোষের অর্থে শাসকরা মানুষের কৃতজ্ঞতা কিনছেন দেখে বিরোধীদেরও স্বভাবতই গাত্রদাহ হয়। তাঁরা কখনও বলেন যে, এ টাকা নেহাতই ভিক্ষা; কখনও ইস্তাহারে না লিখেও প্রচারে গিয়ে বলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে দ্বিগুণ অথবা তিন গুণ করে দেবেন প্রকল্পের টাকার পরিমাণ; কখনও আবার বলেন, রাজ্য শিল্পহীন বলেই এ ভাবে টাকা দিতে হয়। স্পষ্টতই, বিরোধীরাও প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তর প্রকল্পকে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবেই দেখেন— ক্ষমতায় থাকার কারণে যে অস্ত্রের উপরে শাসকের একান্ত অধিকার। শাসক এবং বিরোধী, উভয় পক্ষই যে-হেতু নীতিটিকে নামিয়ে আনেন রাজনীতির তলে, সে কারণেই নীতিটির অন্তর্গত অর্থ বিলুপ্ত হয়— তার অস্তিত্ব জুড়ে যায় রাজনৈতিক দলগুলির ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে।
অথচ, উন্নয়ন অর্থনীতির গবেষণা স্পষ্ট বলছে, সর্বজনীন উন্নয়নের ক্ষেত্রে শর্তহীন নগদ হস্তান্তরের গুরুত্ব বিপুল। বিশেষত, সে টাকা যদি পরিবারের মহিলাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তার উন্নয়ন-ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। পশ্চিমবঙ্গে ঠিক এই কাজটিই হয়েছে— উন্নয়ন অর্থনীতির সূত্র মেনে হয়েছে, না কি ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করার কৌশল হিসাবে, সে প্রশ্ন অবশ্য ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে বিধেয় ছিল, বিরোধীরা এই নীতিটিকে শাসকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন। এই নীতির গুরুত্ব যে কোনও একটি দলের রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে নয়, বরং সামগ্রিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশ হিসাবে, তা স্পষ্ট করে বলবেন। এবং, রাজনৈতিক ক্ষমতায় অদলবদল হলেও যে এই নীতির অভিমুখ পাল্টাবে না, তা জানিয়ে দেবেন। একটি অন্য রকম উদাহরণ দিলে হয়তো কথাটি বুঝতে সুবিধা হবে। ভারতে ১৯৫২ সালের নির্বাচনে যে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রদান করা হবে, তা ছিল তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নীতি। অন্য দল ক্ষমতায় এসে যদি সেই নীতির অভিমুখ পাল্টে দিত, যদি ভোটাধিকারকে ফের জুড়ে দেওয়া হত শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সম্পত্তির পরিমাপের সঙ্গে, তা কি গণতন্ত্রের পক্ষে স্বাস্থ্যকর হত? ঠিক সেই কারণেই উন্নয়ননীতিগুলির ধারাবাহিকতা প্রয়োজন— তা কোন দলের তৈরি, সে কথা বিবেচনা না করেই। কিন্তু, রাজনীতির কাছে সে বিবেচনা প্রত্যাশা করা এখন অর্থহীন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসে এনআরইজিএ-কে কংগ্রেসের ব্যর্থতার স্মৃতিফলক বলেছিলেন। প্রকল্পটি যাতে রক্তাল্পতায় ভোগে, সেই ব্যবস্থাও করেছিলেন। কোভিড তাঁকে এমন যোজনার গুরুত্বের কথা বুঝিয়েছে— অন্তত, কোনও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কের তা বুঝতে পারার কথা। গণতন্ত্রের কি এই ভবিতব্য যে, প্রতিটি উন্নয়ননীতির গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য এমন প্রবল বিপদের অপেক্ষায় থাকতে হবে?