শেষ পর্যন্ত যখন বলিলেনই, এত বিলম্বে বলিলেন কেন? কুম্ভমেলা প্রসঙ্গে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই প্রশ্নটি করা সচেতন নাগরিকের কর্তব্য। প্রধানমন্ত্রী সন্ন্যাসী ও অন্য ভক্তদের নিকট ‘অনুরোধ’ করিয়াছেন, তাঁহারা যেন হরিদ্বারের কুম্ভকে প্রতীকী রূপে উদ্যাপন করেন। তাঁহার অনুরোধে কাজও হইয়াছে— দুইটি আখড়া ব্যতীত আর সকলেই মেলা ফুরাইবার পূর্বেই হরিদ্বার ত্যাগ করিতেছেন, বা করিতে প্রস্তুত। অর্থাৎ, দেশবাসীর উপর, অন্তত যাঁহারা কুম্ভমেলায় যান তাঁহাদের উপর প্রধানমন্ত্রীর প্রভাব আছে। প্রধানমন্ত্রী ও বোধ করি তাহা জানেন। তাহা হইলে তিনি এত দিন অপেক্ষা করিলেন কেন? কুম্ভমেলা ভারতের সর্ববৃহৎ ‘সুপারস্প্রেডার’ হইয়া উঠিতে পারে, এই সম্ভাবনাটিকে বহু পূর্বেই বিনষ্ট করা যাইত, যদি প্রধানমন্ত্রী মেলা শুরু হইবার পূর্বেই এই কথাটি বলিতেন। এমন নহে যে, মার্চ মাসের প্রথমার্ধে যখন হরিদ্বারে মেলার সূচনা হইতেছিল, অথবা তাহারও পূর্বে যখন এই মেলার পরিকল্পনা হইতেছিল, তখন কোভিড-এর বিপদের কথা জানা ছিল না। কুম্ভমেলা পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ। এই মেলা আয়োজিত হইতে দিলে কোনও নিয়ন্ত্রণই যে বজায় রাখা সম্ভব হইবে না, তাহাও অজ্ঞাত থাকিবার কারণ নাই। তবুও মেলার আয়োজন বিষয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনও আপত্তি করেন নাই। একের পর এক ক্ষমতাসীন রাজনীতিক যখন কম্বুকণ্ঠে জানাইয়াছেন যে, যাহাই ঘটুক না কেন, মেলা বন্ধ হইবে না— তখনও তাঁহারা রা কাড়েন নাই। দেশবাসী জানিতে চাহিতে পারে যে, কেন?
ধর্মীয় সমাবেশ হইতে যে বিপজ্জনক ভাবে কোভিড ছড়াইতে পারে, এই কথাটি নূতন কিছু নহে। বস্তুত, এক বৎসর পূর্বে দিল্লির নিজামুদ্দিনে তবলিগি জামাতের একটি সমাবেশ হইয়াছিল। সেই সমাবেশ হইতে কোভিড ছড়াইতেছে— বস্তুত, তাহার আয়োজক ও অংশগ্রাহীরা সজ্ঞানে কোভিড ছড়াইয়া বেড়াইতেছেন— এই মর্মে ভয়ঙ্কর প্রচার চালাইয়াছিল আইটি সেল। কর্তারা দেখিয়াও না দেখিবার ভান করিয়া ছিলেন, মুখ ফুটিয়া বলেন নাই যে, রোগ সংক্রমণের পিছনে কোনও একটি সম্প্রদায়কে তাহাদের ধর্মীয় পরিচিতির কারণে দায়ী করা অন্যায়। সেই সমাবেশের মাপের বহু, বহু গুণ বড় কুম্ভমেলা। সেই মেলা যে দেশের প্রতিটি প্রান্ত কোভিড সংক্রমণের হার বাড়াইয়া তুলিতে পারে, এই কথাটুকুও কি কর্তারা স্মরণ করাইয়া দিতে পারিতেন না? না কি, তাঁহাদের নিকট কর্তব্য, প্রশাসনিকতা ইত্যাদি শব্দ ধর্মের ছাঁকনি পার না করিয়া পৌঁছাইতে পারে না?
কেহ যদি আশঙ্কা করেন যে, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে সত্যই নাগরিকের ধর্মপরিচয় দেখিয়া সরকার কর্তব্য স্থির করে, সেই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। কিন্তু, এই পক্ষপাত সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও উপকার করিতেছে কি? কোভিড মানুষের ধর্ম দেখিয়া আক্রমণ করে না— তবলিগি জামাত হইতে মুসলমানদের সংক্রমিত হইবার যে সম্ভাবনা ছিল, কুম্ভমেলায় হিন্দুদের সংক্রমিত হইবার সম্ভাবনা তাহার তুলনায় কম নহে। সম্ভবত বেশি, কারণ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করিতেছেন যে, ভাইরাসের নূতন স্ট্রেনটির সংক্রামক ক্ষমতা অধিকতর। যদি ধরিয়া লওয়া যায় যে, হিন্দুদের অধিকতর মেলামেশা হিন্দুদের সহিতই, তাহা হইলে কুম্ভ হইতে সংক্রমিতরা আরও অনেক হিন্দুকে সংক্রমিত করিবেন— যাঁহারা মেলায় যান নাই, তাঁহাদেরও। তবুও, এই পক্ষপাতই বাস্তব, কারণ তাহাতে ভোট আছে। তাহাতে নাগরিকের সর্বনাশ হইলেও ভোটের স্বার্থের অধিক— বর্তমান ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের ভোট— আর কিছুই রাজনীতির চোখে পড়ে না। কোনও কুম্ভস্নানই কি রাষ্ট্রের শরীর হইতে এই পাপ মুছিতে পারিবে?