কোয়াড গোষ্ঠীর বৈঠকে জয়শঙ্কর। ছবি পিটিআই।
ভারত, আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া— শক্তিধর রাষ্ট্র চতুষ্টয় বা কোয়াড-এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হইল গত শুক্রবার। এই জোটের প্রাথমিক লক্ষ্য— প্রতিরক্ষা। গত বৎসর ভারত আয়োজিত বার্ষিক মালাবার নৌ-মহড়ায় আমেরিকা ও জাপানের সহিত অস্ট্রেলিয়াও আমন্ত্রিত হওয়ায় যাহার ভিত পোক্ত হইয়াছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বৈঠকে কোয়াডের ক্ষেত্রটি বিস্তৃত করিবার কথাই শুনা গেল। চতুর্দেশীয় অক্ষ জানাইল, সহযোগিতা বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত আদানপ্রদান গভীর করাই তাহাদের লক্ষ্য। বস্তুত, গঠিত হইবার চৌদ্দ বৎসর পর প্রথম বৈঠকে দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার অন্বেষণ হইয়াছে। উক্ত ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চলে কল্যাণমূলক উদ্যোগ লইয়া আলোচনা তাহার প্রাথমিক ধাপ। নরেন্দ্র মোদীও বলিয়াছেন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সুস্থিতির স্তম্ভস্বরূপ হইতে পারে কোয়াড।
চিন কর্তৃক কোয়াড-কে ‘এশীয় ন্যাটো’ ও নয়া ঠান্ডা যুদ্ধের অগ্রদূতের তকমা আন্তর্জাতিক মহলকে বিস্মিত করে নাই। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা শক্তিটি এশীয় প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে ক্রমশ আগ্রাসী হইতেছে, প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাহাদের আধিপত্য নেতৃত্ব হইতে কর্তৃত্ব পাল্টাইতেছে। ভারসাম্য রক্ষার সম্ভাব্য অক্ষের সক্রিয়তা তাই তাহাদের নিকট অস্বস্তির কারণ। কোয়াডের কোনও শক্তির সহিতই অদ্যাবধি সরাসরি সংঘাতে যায় নাই বেজিং। সুসম্পর্কে আপনাদের লভ্যাংশ সম্পর্কে তাহারা সম্যক অবগত। কিন্তু পূর্ব লাদাখে চিনের আগ্রাসন লইয়া অপর তিন রাষ্ট্র যে ভাবে ভারতের পাশে দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে বেজিং কত দিন নিরুত্তর থাকিবে, উহা নিশ্চিত নহে। নয়াদিল্লির পক্ষে সবটুকুই সদর্থক— জোটের সক্রিয়তা, বিশ্বশক্তির সহায়তা ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন। চিন-বিরোধিতার উদ্দেশ্যে এই জোটের জন্ম না হইলেও ঘটনাক্রম যদি তাহার ভবিতব্যকে সংঘাতের সম্মুখীন করে, তবে তাহা ভারতের পক্ষেও বিশেষ তাৎপর্যবাহী। জোটকে যত্ন করিবার তাগিদটি ভারতের ক্ষেত্রে তাই প্রবল হওয়া উচিত।
একটি উদ্বেগের কথা অবশ্য থাকিয়া যায়। উক্ত বৈঠকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন রাষ্ট্রে একশো কোটি কোভিড টিকার ডোজ় সরবরাহ করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছে দিল্লি। বলিয়াছে, উহাতে ভারতের উৎপাদন ক্ষমতার দক্ষতাকে কাজে লাগানো হইবে। বিশেষজ্ঞ মহল হইতে প্রশ্ন উঠিতেছে, সত্যই কি ইহা সম্ভব? ভারতের অভ্যন্তরীণ সরবরাহ অক্ষুণ্ণ রাখিয়া উৎপাদন ক্ষমতা কি এতটা অতিরিক্ত বোঝা বহন করিতে সক্ষম? টিকার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যাইবার জায়গায় কি ভারত আছে? দিল্লির মত, আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় দ্রুতগতিতে টিকা রফতানি করিতেছে বেজিং, এই বার তাহার সহিত পাল্লা দেওয়া যাইবে; বিদেশি বিনিয়োগে কর্মসংস্থানও বাড়িবে। কিন্তু চিনের সহিত পাল্লা দিবার ক্ষমতা এই মুহূর্তে কতখানি বাস্তব, আর কতখানি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাহার একটি সুবিবেচনা জরুরি। কূটনীতিতে রাজনীতির তাগিদ স্বাস্থ্যকর নহে। জোটের চিন-বিরোধী কূটনীতি আপনার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করিলে সরকারের প্রচার হইবে, দেশের নাগরিকের মঙ্গল হইবে না। স্বল্পমেয়াদে যাহাতে লাভ, দীর্ঘমেয়াদে তাহাতেই ক্ষতি।