দীর্ঘ সময় ঢাকাচাপা দিয়ে রাখা বিক্ষোভের পুঞ্জিত প্রকাশ। ছবি: রয়টার্স।
শহরে এক ফ্ল্যাটবাড়িতে আগুন লেগেছিল। এমন দুর্ঘটনার কথা তো কতই শোনা যায়, ক্ষয়ক্ষতি হতাহতের সংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধি, দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের দ্রুতির উপর নির্ভর করে জনমানসে তার প্রতিক্রিয়া। কিন্তু জিনঝিয়াং প্রদেশের উরুমছি শহরে ফ্ল্যাটবাড়ির অগ্নিকাণ্ড যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় জনবিক্ষোভের আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চিনের ছোট বড় নানা শহরে, রাজপথে, বিশ্ববিদ্যালয়েও, তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। উরুমছি শহরে গত তিন মাসেরও বেশি সময় লকডাউন চলছে, নাগরিকদের এলাকা বা শহর ছেড়ে বেরোনো নিষেধ, প্রশাসন প্রায় গৃহবন্দি করে রেখেছে। এই পরিস্থিতিতে অগ্নিকাণ্ড, লকডাউনের বিধিনিষেধের জেরে দমকলের পৌঁছতে দেরি হওয়ায় অন্তত দশ জনের মৃত্যু— সাধারণ মানুষের ক্ষোভ অত্যন্ত সঙ্গত। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল গত কয়েক দিনে এই বিক্ষোভের স্থানিক থেকে সামগ্রিক হয়ে ওঠা— চিনা প্রশাসনের কোভিড-নীতির বিরোধিতাকে প্রথম পদক্ষেপ করে নিয়ে দেশ জুড়ে বৃহত্তর জনপ্রতিবাদ শুরু করা ও ছড়িয়ে দিতে পারা। তাই বেজিং, শাংহাই, উহান, নানঝিং, চেন্দুং-সহ চিনের বহু শহরের রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল, মোমবাতি পদযাত্রা, সমস্বরে সমাজতন্ত্রের জয়গান ‘ইন্তারনাশিয়োনেল’ গাওয়া, চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর পদত্যাগের দাবি, সর্বোপরি মানবাধিকার ও প্রকৃত নাগরিক স্বাধীনতার দাবিতে আশ্চর্যের কিছু নেই, এই সবই দীর্ঘ সময় ঢাকাচাপা দিয়ে রাখা বিক্ষোভের পুঞ্জিত প্রকাশ।
তবু বিস্ময় জাগে, দেশটি চিন বলেই। আশির দশকের শেষের তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে গণতন্ত্রপন্থীদের প্রতিবাদ ও তার পরিণাম বিশ্ব ভোলেনি। কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে চিনা নাগরিকদের এই প্রতিবাদ পরম্পরা হয়ে উঠতে পারেনি সে দেশের শাসকদের দমননীতির কারণেই, শি জিনপিং-এর তৃতীয় দফার শাসনকালও তার ব্যতিক্রম নয়— বরং একুশ শতকের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নাগরিকের উপরে প্রশাসনের নজরদারি বেড়েছে আরও। কোভিড-নীতি ও বিধিনিষেধের কড়াকড়ি করেছে বিশ্বের বহু দেশ, কিন্তু চিনা সরকারের মতো আর কেউই নয়— সেখানে সাধারণ মানুষ খাবার, জল, ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা কিছুই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ, অতিমারির দু’টি বছর পরেও, বিশ্ব জুড়ে জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সমস্যা আসলে যত না অতিমারি নিয়ন্ত্রণের, তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতার প্রয়োগ তথা অপপ্রয়োগের। একচ্ছত্র ক্ষমতার যা কাজ তা-ই চলেছে চিনে, নিয়ন্ত্রণের নামে নাগরিক পীড়ন— কোনও একটা উপলক্ষ খুঁজে নিয়ে, এ ক্ষেত্রে কোভিড-জনিত লকডাউন। আশার কথা, চিনা নাগরিকেরা শাসকের ছকটি বুঝে গিয়েছেন, তাই তাঁরা পথে নেমেছেন শাসকের চোখরাঙানি শাস্তি নিগ্রহ অগ্রাহ্য করে, এবং বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন বৃহত্তর, গভীরতর সত্যগুলি: স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। বিস্ময় জাগে তাঁদের হাতে প্রতিবাদের সহজ অথচ অমোঘ অস্ত্রটি দেখে— এক খণ্ড সাদা কাগজ, ক্ষমতান্ধ শাসক নাগরিককে যা বলতে দেয়নি, বলতে দেয় না, তার প্রতীক। কুশাসকের বিরুদ্ধে স্থিরলক্ষ্য হয়ে, ক্ষুদ্র স্থানিক প্রতিবাদকে কেমন করে বৃহতের পথে চালনা করতে হয়, চিনের জনপ্রতিবাদ তা বুঝিয়ে দিল।