ফুরোল শারদোৎসব।
শারদোৎসব ফুরোল, প্রতি বছরের মতো শিল্পরসিকদের মনে রেখে গেল প্রশ্নও: কয়েক দিন জুড়ে পূজা, অঞ্জলি, প্রথাপালনের সমান্তরালে প্রতিমা, মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা, এক-একটি অত্যাশ্চর্য ‘থিম’-এর শিল্পিত বাস্তবায়ন— এর কি সংরক্ষণ হতে পারে না? শাস্ত্রমতে প্রতিমার ‘বিসর্জন’ নয়, ‘নিরঞ্জন’ হয়, মৃন্ময়ী চিন্ময়ী রূপে অধিষ্ঠিতা হন পুনর্বার, ভক্ত-মন তৃপ্ত হয় তাতে। কিন্তু শিল্পীর মন— কিংবা শিল্পপ্রেমীর— যা স্বভাবত অতৃপ্ত, যা সুন্দরকে ধরে রাখতে চায়, যেতে দিতে চায় না, তার ক্ষেত্রে? কলকাতা ও বাংলা জুড়ে নয়নাভিরাম প্রতিমা ও মণ্ডপের শিল্পসুষমা দেখে এ প্রশ্ন ওঠা অমূলক নয়, যে শিল্পীরা এই শিল্পযজ্ঞের যাজ্ঞিক, তাঁদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধায়ও কি এই সমস্ত সংরক্ষণ করা যেতে পারে না? শিল্পবেত্তারাও বিলক্ষণ বোঝেন, কলকাতা ও বাংলার দুর্গাপূজার সিংহভাগ শিল্পবস্তু হিসেবে সংগ্রহশালায় স্থান পাওয়ার দাবিদার। এক-একটি মণ্ডপ সজ্জিত হয় লোকশিল্প, ধ্রুপদী শিল্প ও সমসময়ের শিল্পধারার শ্রেষ্ঠ নিদর্শনে, উৎসবের পরে তাদের যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা হলে বিশ্ব তা দেখে শ্রদ্ধায় সন্নত হত। বিশেষত এ বছর ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতেও কি এই সংরক্ষণ জরুরি নয়?
আবেগ যা-ই বলুক, যুক্তি অন্য কথা বলবে। খোদ শিল্পীরা বলবেন, শিল্পবস্তু হিসেবে অনন্যসাধারণ হলেও এর অনেক কিছুই সংরক্ষণযোগ্য নয়। প্রতিমা তৈরি হয় মাটি দিয়ে, তা স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষয়শীল। ধাতু, ফাইবার গ্লাস-সহ বিবিধ উপকরণেও আজকাল প্রতিমা তৈরি হয়, সেগুলি চাইলে সংরক্ষণ করা যায়, কিছু কিছু হয়ও— সরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সংগ্রহশালায়, কিংবা বিলাসবহুল হোটেল ও হর্ম্যে, রবীন্দ্র সরোবরের একাংশে জায়গা করে। কুমোরটুলি থেকে বিদেশে পাঠানো ফাইবারের দুর্গাপ্রতিমা প্রবাসীরা পূজার পর রেখে দেন, তাতেও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ-সহ অনেক কিছু খেয়াল রাখতে হয়, প্রবাসে উন্নত প্রযুক্তি-পরিকাঠামোয় তা সম্ভব হয়। মণ্ডপসজ্জার কাঁচামাল— বাঁশ বেত কাঠ দড়ি শোলা রং মাটি ইত্যাদি— মুখ্যত প্রকৃতিজ, এবং নশ্বর; এ-সবের ব্যবহারে ও আলোর মায়ায় শহরের বুকে চোখ-ধাঁধানো বুর্জ খলিফা বা বাস্তবের ভগ্নপ্রায় জমিদারবাড়ির অবিশ্বাস্য নকলটি উদয় হলেও উৎসব-শেষে তাদের রেখে দেওয়া যায় না। তার জায়গাও নেই। শহরে মানুষেরই স্থান অকুলান, প্রতিমা ও শিল্পবস্তুর ঠাঁই হবে কী করে।
তবে শিল্পবস্তু সংরক্ষণের ব্যবহারিক সমস্যার বাইরেও আর একটি দিক আছে: সংরক্ষণ কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ঔদাসীন্য। যে সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষ বা কয়েক জন শিল্পবোদ্ধা কিছু প্রতিমা ও শিল্পবস্তু সংরক্ষণ করেছেন, তাঁরা তার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলটি জানেন। সেটি সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ, সকলের অধিগম্য নয়, কিন্তু সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় তা সহজতর হতে পারে। একুশ শতকের পশ্চিমবঙ্গে শিল্পশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির পাঠ্যক্রমে ‘কনজ়ার্ভেশন’ ও ‘রেস্টোরেশন’-এর পাঠ খুবই কম, বা নেই বললেই চলে। কাজের কাজিরাই যে বিদ্যা জানেন না, সেখানে সাধারণ মানুষ বা সরকারের জ্ঞান নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। যত দিন না সেই শিক্ষা আয়ত্ত ও সুলভ হবে, তত দিন দুর্গাপূজার পরে শিল্পকে এ ভাবে ‘জলে ফেলা’র হাহুতাশ চলতে থাকবে।