Syndicate Raj

বাঘের পিঠে

সিন্ডিকেটকে কেন নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সেই প্রশ্নের একটি উত্তর রাজারহাটে মিলিলে অন্য একটি উত্তর মিলিবে হলদিয়ায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২১ ০৫:৫৯
Share:

সিন্ডিকেট নামক ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবটির সৃষ্টিকর্তা কে, এই প্রশ্ন উঠিলে চাপানউতোর চলিবেই। বামপন্থীরা মুখ মুছিয়া বলিবেন, তাঁহাদের জমানায় রাজারহাটে কো-অপারেটিভ ছিল— তৃণমূল কংগ্রেস আসিয়া সিন্ডিকেট ব্যবস্থার সৃষ্টি করিয়াছে। তৃণমূল কংগ্রেস বলিবে, তাহারা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবস্থাটি পাইয়াছে মাত্র। বিজেপির এখনও জবাব দিবার দায় নাই, কিন্তু ভাবগতিক দেখিলে অনুমান করা চলে, কখনও যদি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা তাহারা রাজ্যে অধিকার করে, তাহারাও হাত ধুইয়া ফেলিবে না। কেন প্রতিটি দলই পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট বা সমগোত্রীয় ব্যবস্থাকে তোল্লাই দিয়া চলে, সেই প্রশ্নের উত্তর আছে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থায়। পশ্চিমবঙ্গে বৃহৎ শিল্প নাই, ফলে বড় মাপের কর্মসংস্থানও নাই। যাহা আছে, অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় তাহাকে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। এই অবস্থায়, ‘রেন্ট সিকিং’ স্বভাবতই আকর্ষক বিকল্প হইয়া দাঁড়ায়— তাহা রোজগারের অপেক্ষাকৃত সহজ রাস্তা। এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ব্যবহার করিয়া নির্মাণক্ষেত্র হইতে পয়সা আদায় সেই ‘রেন্ট সিকিং’-এরই নমুনা। যে হেতু রাজ্যে কর্মসংস্থান নাই, ফলে রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকিয়া সিন্ডিকেটে কাজ করিতে বহু যুবকই আগ্রহী। আবার, তাঁহাদের হাতে রাখিতে রাজনৈতিক দলগুলিও আগ্রহী, কারণ পদাতিক ছাড়া যুদ্ধ অসম্ভব। ফলে, সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় না দিয়াও তাহাদের উপায় নাই।

Advertisement

নেতারা যে কথাটি গোপন করিবার চেষ্টা করেন, তাহাও নহে। যেমন, তৃণমূল কংগ্রেস হইতে সম্প্রতি বিজেপিতে যোগ দেওয়া রাজারহাট অঞ্চলের এক নেতা একদা বলিয়াছিলেন, সিন্ডিকেটের গায়ে হাত পড়িলে সরকার পড়িয়া যাইতে পারে। কথাটি লইয়া প্রচুর বিতর্ক হইয়াছিল, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির সহিত সিন্ডিকেটের স্বার্থের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটি তাহাতে ঢাকা পড়ে নাই। নেতারা প্রকাশ্যে বলিয়া থাকেন, কর্মসংস্থানের এই পথটি সাধারণ মানুষের স্বার্থেই খোলা রাখা বিধেয়। সিন্ডিকেট হইতে নির্মাণসামগ্রী বা শ্রমিক লইতে তো কাহাকে জোর করা হয় না— কেহ স্বেচ্ছায় চাহিলে কিনিতে পারেন। কথাটির মধ্যে কয় আনা সত্য আছে, রাজ্যবাসী অভিজ্ঞতায় জানেন। কর্মসংস্থানের সমস্যাটির অর্থনৈতিক বা প্রশাসনিক সমাধানসূত্র খুঁজিয়া না পাওয়ায় এই রাজনৈতিক পথটি অবলম্বন করিবার বাধ্যবাধকতা যেমন সত্য, তেমনই ইহাও সত্য যে, সিন্ডিকেটের নামে নিখাদ জুলুম চলে। এবং, আরও সত্য এই কথাটি যে, প্রশাসন চাহিলে সিন্ডিকেটের জুলুম থামাইতেও পারে। গত দুই বৎসরে প্রশাসন কঠোর হওয়ায় রাজারহাট অঞ্চলে সিন্ডিকেটের দাপট কমিয়াছে, এমনই সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা।

সিন্ডিকেটকে কেন নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, সেই প্রশ্নের একটি উত্তর রাজারহাটে মিলিলে অন্য একটি উত্তর মিলিবে হলদিয়ায়। এক দিকে যেমন সিন্ডিকেটের জুলুমে নির্মাণের ব্যয় বাড়িয়া যায়, ফলে ফ্ল্যাটের দাম ন্যায্য স্তরের তুলনায় বেশি হয়, অন্য দিকে নির্মাণের গুণমানও ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, বাজারে সার্বিক ভাবে চাহিদা পড়িয়া যায়। তাহার প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানে, নির্মাণসামগ্রীর সার্বিক চাহিদায়। অন্য দিকে, হলদিয়ার অভিজ্ঞতা বলিবে, এই সিন্ডিকেটের জুলুমে এক বহুজাতিক সংস্থা বন্দরের কাজ ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইল, এবং তাহার ফলে বন্দর-বাণিজ্যের একটি বড় অংশ চলিয়া গেল প্রতিবেশী রাজ্যে। অর্থাৎ, সিন্ডিকেটের জুলুমে যে শুধু ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতি হয়, তাহাই নহে— ক্ষতি সমগ্র রাজ্যের অর্থব্যবস্থার। মুশকিল হইল, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবটিকে এক বার ছাড়িয়া দিলে তাহার লাগাম ধরিবার উপায় স্বয়ং সৃষ্টিকর্তারও থাকে না। ফলে, বাঘের পিঠে চড়িয়া যত দূর যাওয়া যায়, রাজনীতিকরা তাহার ভরসায় আছেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement