PM Narendra Modi

বেত্রাঘাত

আত্মবিশ্বাস আর ঔদ্ধত্যের মধ্যে ভেদরেখাটি সূক্ষ্ম, ক্ষমতাধরের কাছে দু’টিই সমার্থক। নরেন্দ্র মোদীর নিজমুখে ‘বিজেপি সরকার ৩.০’ নিয়ে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা তাঁর ভক্ত-সমর্থকদের কানে সুধা ঢালতে পারে, কিন্তু এই ঘোষণা গণতন্ত্রের পরিপন্থী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৪ ০৭:৩৯
Share:

— ফাইল চিত্র।

নিশ্চিন্দিপুরে প্রসন্ন গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় বেত ছাড়া শিক্ষাদানের উপকরণ-বাহুল্য ছিল না, গুরুমহাশয়ও তাঁর ‘শিক্ষাদানের উপযুক্ত ক্ষমতা ও উপকরণের অভাব’ মেটাতে তার বেপরোয়া ও যথেচ্ছ ব্যবহার করতেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পথের পাঁচালী পড়েছেন বলে মনে হয় না, পড়লে বুঝতেন, তাঁর ‘শিক্ষাদান’ পদ্ধতিটিও ওই রকমই। কেন্দ্রীয় সরকারের নানা মন্ত্রকের সচিবদের এক বৈঠকে সম্প্রতি তিনি বলেছেন, তাঁর সামনে এখন ভোটের ‘এগজ়ামিনেশন’, আর আমলাদের ‘ভেকেশন’। তা বলে ছাড় নেই, ছুটির মধ্যেও আমলাদের ‘হোমওয়ার্ক’: আগামী একশো দিনের কাজের রূপরেখা, পাঁচ বছরের কাজের লক্ষ্য তৈরি। ‘গুরুমহাশয়’ ফিরে এসে সে সব নিয়ে বসবেন— বেতের ব্যবহারও কি হবে না তখন?

Advertisement

‘আগামী’ একশো দিন বা পাঁচ বছর মানে কী? আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের পর যে দল ক্ষমতায় আসবে ও সরকার গড়বে, আমলাদের হোমওয়ার্ক দেওয়ার প্রসঙ্গে সেই ‘নতুন’ সরকারের কাজ ও লক্ষ্যের কথাই বলতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর শব্দচয়ন ঠাট্টা গোছের হলেও ভঙ্গিটি নয়, কোনও রাখঢাক না করেই তিনি বলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকারে আবার ফিরে আসবেন সেই তিনিই— সুতরাং দেরি করে লাভ কী, পরবর্তী কাজের প্রস্তুতি আগে হয়ে থাকা ভাল! আবার এ যে কোনও বিক্ষিপ্ত মন্তব্য তাও বলা যাচ্ছে না, কারণ কিছু দিন আগে বিদায়ী মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকেও তিনি বলেছেন একই কথা: তাঁর সরকারই ক্ষমতায় ফিরছে, ফিরেই কাজে নেমে পড়তে হবে। ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর নেহাত এখন আদর্শ নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলার ব্যাপার রয়েছে, নইলে হয়তো বা ‘নতুন’ সরকারের প্রস্তাবিত নানা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতেও তিনি ও তাঁর দল পিছপা হতেন না।

আত্মবিশ্বাস আর ঔদ্ধত্যের মধ্যে ভেদরেখাটি সূক্ষ্ম, ক্ষমতাধরের কাছে দু’টিই সমার্থক। নরেন্দ্র মোদীর নিজমুখে ‘বিজেপি সরকার ৩.০’ নিয়ে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা তাঁর ভক্ত-সমর্থকদের কানে সুধা ঢালতে পারে, কিন্তু এই ঘোষণা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন স্বরাট স্বয়ংসম্পূর্ণ এক প্রক্রিয়া— একটি দল যত বারই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরুক ও সরকার গড়ুক না কেন, এক জন রাজনৈতিক নেতা যত বারই দেশের প্রধান পদটিতে বসুন না কেন, প্রতিটি মেয়াদ পৃথক। আগের মেয়াদের সঙ্গে তার নানা গঠনগত পার্থক্যের জন্যই নয়, গণতন্ত্রের দর্শন অনুযায়ীই তারা আলাদা। এবং সেই কারণেই শীর্ষ স্তরের আমলাদের সামনে প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন না তাঁর দলই ক্ষমতায় ফিরছে, তিনিই আবার প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। আবেগ-গরগর জনসভায় সমর্থকদের মনোবল বাড়াতে যে কথা বলা যায়, শাসনব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি আমলাদের সামনে তা বলা যায় না, কারণ সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা হয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী পদটিও এক অর্থে ‘বিদায়ী’: ভোটের ফল ঘোষণার পর দেশ পাবে নতুন সরকার, নতুন প্রধানমন্ত্রী। তাই সরকার গড়া দূরস্থান, নির্বাচনও যখন হয়নি, তখন অনাগত কালের সরকারি কাজের নিদান হেঁকে দেওয়া আগাগোড়া অগণতান্ত্রিক এক কাজ। আর যে ভাবে ও ভাষায় সে কাজ করা হল তা আমলাদের পক্ষে যেমন অবমাননাকর, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের জন্যও দুর্ভাগ্যের। গুরুমহাশয়কে তা কে শেখাবে? এ যে ক্ষমতার বেত হাতে চোখ রাঙানোরই আর এক উদাহরণ, বোঝাবে কে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement